নিখরচায় সরকারি পরিষেবা পেতে এখন থেকে আর দারিদ্রসীমার নীচের বাসিন্দা হওয়ার দরকার পড়বে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার ঘোষণা করেছেন, রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও চাইলে যে কেউ কার্যত বিনা পয়সায় চিকিৎসার সুবিধা নিতে পারবেন। রাজ্যের জেলা হাসপাতালগুলিতে আগেই চালু হয়েছিল এই ব্যবস্থা। মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণার নির্যাস হলো, এখন থেকে কোনও সরকারি হাসপাতালে পেয়িং বেড বলে আর কিছু থাকবে না। গুটিকয়েক কেবিন বাদ দিয়ে বাকি সবই ফ্রি বেড। আর সেখানে ভর্তি হলে যে শুধু বেড ভাড়া দিতে হবে না, তা-ই নয়। লাগবে না চিকিৎসার প্রায় কোনও খরচই। যে সুবিধা এত দিন সীমাবদ্ধ ছিল সামর্থহীন দরিদ্রদের জন্য, খয়রাতির অঙ্কে এ বার তা সবার জন্যই খুলে দিলেন মমতা। নতুন এই ব্যবস্থা এক মাসের মধ্যে চালু হয়ে যাবে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। এ ব্যাপারে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে সোমবার।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, যাঁরা চিকিৎসার খরচ অনায়াসে বহন করতে সক্ষম, তাঁদের জন্যও কেন সব ‘ফ্রি’ করা হবে? নতুন ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আয় হবে কোথা থেকে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। স্বাস্থ্য কর্তাদের এই অংশের আরও প্রশ্ন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে বিপুল আর্থিক দায় চাপবে, তার জন্য নতুন প্রকল্পও কি মুখ থুবড়ে পড়বে না? পাশাপাশি যদি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করতে হয়, তা হলে এই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি-রাজ বন্ধ করতেই হবে বলে মানছেন তাঁরা।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, জেলাস্তর পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে পেয়িং বেড গত বছর অক্টোবরেই তুলে দিয়েছে রাজ্য সরকার। ফ্রি করা হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যবস্থাও। ফলে রোগী কল্যাণ সমিতির আয় অনেকটাই কমেছে। দফতরের এক কর্তা জানান, রোগী কল্যাণ সমিতির টাকায় সরকারি হাসপাতালগুলির অনেক খরচই উঠে আসে। এ বার মেডিক্যাল কলেজ স্তর পর্যম্ত সব ‘ফ্রি’ হলে কী ভাবে হবে সেই বাড়তি অর্থের সংস্থান? ওই কর্তার জবাব, ‘‘আসলে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন খাতে প্রচুর টাকা পাচ্ছে রাজ্য। সেই টাকা খরচের জন্য কিছু নতুন প্রকল্প দরকার। তাই এই দানছত্র! অথচ এই অর্থে তো স্বাস্থ্যে স্থায়ী সম্পদ গড়া যেত। তাতে আরও অনেক লোক উপকৃত হতেন।’’ ওই স্বাস্থ্য কর্তার মন্তব্য, ‘‘এই জাতীয় ঘোষণা বা কাজে সুনাম হবে, অথচ নিজেদের টাকা খরচ করতে হয় না!’’
তবে কি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা করাতে আর কোনও খরচই লাগবে না?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সাধারণ শয্যা ‘ফ্রি’ হচ্ছে। মানে কোনও স্তরের সরকারি হাসপাতালেই আর ‘পেয়িং বেড’ বলে কিছু থাকবে না। তবে কেবিনে ভর্তি হলে তার ভাড়া গুণতে হবে রোগীকে। এ ছাড়া পিপিপি মডেলে যে সব পরীক্ষানিরীক্ষা হয়, তার খরচ লাগবে আগের মতোই। অর্থাৎ, নতুন ব্যবস্থায় শয্যার ভাড়া এবং ওষুধের খরচ রোগীকে বহন করতে হবে না। ইসিজি, হৃদরোগ ও রক্তের জটিল রোগের চিকিৎসা, রক্ত-মল-মূত্রের পরীক্ষা এবং কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি-সহ ক্যানসারের বিভিন্ন চিকিৎসাও করানো যাবে বিনামূল্যে। যা এত দিন হত না। কিন্তু সিটি স্ক্যান বা এমআরআই কিংবা আলট্রাসনোগ্রাফির মতো পরীক্ষার খরচ লাগবে।
হার্টের অস্ত্রোপচার ‘ফ্রি’ হলে কি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির স্টেন্টের দাম লাগবে না? সুশান্তবাবুর জবাব, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ সেটাই।’’ যদিও বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের কর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই। শয্যার ভাড়া, অস্ত্রোপচারের অন্যান্য খরচ মকুব করা যায়। কিন্তু সরঞ্জাম কিনে দিতে হলে তাঁরা ফতুর হয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন উদ্বিগ্ন হাসপাতাল কর্তাদের অনেকেই। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘কোথা থেকে খরচ জোগাড় হবে, তার কোনও সূত্র আমাদের কাছে নেই! আমরা অথৈ জলে! ক’দিন পরে রোগীরা সমস্ত কিছু দাবি করলে আমরা কী করব, জানি না!’’
এ দিন রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর এবং পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও অর্থ নিগম আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যের ৭৬%-র বেশি মানুষ সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা পান। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য সচিব মলয় দে-কে পাশে রেখে তিনি বলেন, ‘‘লোকে ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে পারে না। আমরা বিনা পয়সায় ওই চিকিৎসা দেব।’’ এত দিন শুধু বিপিএল রোগীদের নিখরচায় কেমোথেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। এ বার সমস্ত ধরনের ক্যানসার, হার্টের সমস্যা এবং রক্তের নানা সমস্যার চিকিৎসা মেডিক্যাল কলেজেও নিখরচায় করা হবে বলে জানান তিনি। দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘মেডিক্যাল কলেজগুলিকে ফ্রি-এর আওতাভুক্ত করায় বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’’