ধারে কয়লা কিনতে কিনতে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দু’হাজার কোটি টাকার উপর। এখন সেই টাকা চেয়ে তাগাদা এলেও তা শোধ করার মতো সামর্থ্য নেই। অগত্যা রাজ্যের থেকে বিনা সুদে ১০০০ কোটি ধার চেয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম। পাওয়া গেলে সমস্যা আপাতত মিটতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, তাতে অর্থ দফতর ঋণ দেওয়ার অবস্থায় নেই। এ দিকে টাকা না পেলে কয়লার জোগান কমবে, যার জেরে পুজোর মরসুমে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিদ্যুৎ নিগমের কর্তারা।
কিন্তু কেন এত বকেয়া?
বিদ্যুৎ দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লা আসে কোল ইন্ডিয়ার কাছ থেকে। বিদ্যুৎ বিক্রি করে পাওয়া টাকা থেকে সেই বকেয়া মেটায় নিগম। কিন্তু কোল ইন্ডিয়ার থেকে কেনা কয়লায় দাম এবং বিদ্যুৎ বেচে পাওয়া টাকার মধ্যে ফারাক হওয়ার কারণেই বকেয়ার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এত বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিগমের এক কর্তা জানান, রাজ্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি চালু রাখতে প্রতি দিন ১৪ রেক কয়লার দরকার হয়। এর দাম গড়ে সাত থেকে আট কোটি টাকা। ওই টাকার পুরোটা সব সময়ে নিগমের পক্ষে মেটানো সম্ভব হয় না। সেই বকেয়াই জমতে জমতে দাঁড়িয়েছে ২২০০ কোটি টাকায়।
নিগম কর্তাদের আরও যুক্তি, রাজ্যের হাতে ঝাড়খণ্ডের পাঁচোয়ারা উত্তর, বাঁকুড়ার বড়জোড়া উত্তর, বীরভূমের গঙ্গারামচক, গঙ্গারামচক-বাদুলিয়া, বড়জোড় এবং রানিগঞ্জের তারা উত্তর ও দক্ষিণে সাতটি কয়লার ব্লক রয়েছে। এমটা গোষ্ঠীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এই ব্লকগুলি থেকে কয়লা তুলত রাজ্য। সেই কয়লার দাম অঙ্কের হিসেবে কিছুটা কম পড়ত। কিন্তু কয়লা কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর থেকে ওই ব্লকগুলি থেকে উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত মেনে পাঁচোয়ারা উত্তর এবং বড়জোড়া উত্তর ব্লক দু’টির নিলাম হলেও মামলার জটে সেখান থেকে কয়লা তোলা শুরুই হয়নি। আবার মামলা থাকায় অন্য ব্লকগুলির নিলাম হয়নি। এক নিগম কর্তার কথায়, ‘‘রাজ্যের নিজের কয়লা খনি থাকলেও কয়লা তোলা যাচ্ছে না। কোল ইন্ডিয়ার কয়লার উপরেই ভরসা। বেশি দামে কয়লা কিনতে হচ্ছে বলে আর্থিক বোঝাও চাপছে।’’
২০১৪ থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত কয়লার দাম বকেয়া পড়েছে ২২০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি কোল ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ রাজ্যের বিদ্যুৎ সচিব এস কিশোরকে চিঠি লিখে এই বকেয়া মেটানোর অনুরোধ করেছেন। প্রচ্ছন্ন ভাবে এ-ও বলে দেওয়া হয়েছে যে, দাম না মেটালে কয়লা সরবরাহ বজায় রাখা কঠিন হবে। সমস্যা কাটাতে অর্থ দফতরের কাছে ১০০০ কোটি ঋণ চেয়েছে নিগম। কিন্তু তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি অমিত মিত্রের অর্থ দফতর।
নবান্নের খবর, বকেয়া মেটাতে গত মার্চ মাসে, ভোটের আগে ৩০০ কোটি ধার চেয়েছিল নিগম। ওই সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঠেকাতে ২০০ কোটি ঋণ দিয়েছিল রাজ্য। এর পরে এপ্রিল মাসে ফের ৬০০ কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হলেও অর্থ দফতর জানিয়ে দেয়, নিগমকেই টাকা জোগাড় করতে হবে। পাশাপাশি আসে কোল ইন্ডিয়ার তাগাদা এবং হুঁশিয়ারি।
গোটা ঘটনায় বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘‘অর্থ দফতর আমাদের প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করছে বলে জেনেছি। বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইনের ফলে বাজার থেকেও ইচ্ছে মতো ঋণ নেওয়া মুশকিল। অর্থ দফতরের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।’’
অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তা অবশ্য জানান, নিগমগুলি নিজেদের খরচ নিজেরা চালাবে, সেটাই কাম্য। রাজ্য সরকারকে এ মাসেই বাজার থেকে ১৫০০ কোটি টাকা ধার নিতে হয়েছে। ১০% অন্তর্বর্তী সুবিধা দেওয়ার জন্য এ মাস থেকে বেতন বাবদ খরচও বাড়ছে। ফলে নিগমকে ১০০০ কোটি ঋণ দেওয়া মুশকিল।
তা হলে উপায়? বিদ্যুৎমন্ত্রীর কথায়, ‘‘বিকল্প ভাবতে হবে। গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষা করেই কোনও পথ খুঁজতে হবে।’’ বিদ্যুৎমন্ত্রী এ কথা বললেও নিগম-কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, দাম কিছুটা না বাড়লে আয়-ব্যয়ের ফারাকটা কমানো কঠিন। নিগম ফের লোকসানে ভুগবে।