সেতু-তদন্ত/২

গুদাম ঢুঁড়ে মালমশলার হাল দেখবে কমিটি

বিধ্বস্ত উড়ালপুল পরিদর্শনই শুধু নয়। নির্মাতা সংস্থার গুদামেও হানা দেবেন খড়্গপুর আইআইটি-র দুই বিশেষজ্ঞ। ঠিক কী ধরনের মাল-মশলা দিয়ে বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুল তৈরি হচ্ছিল, তার আন্দাজ পেতেই রাজ্য সরকারি তদন্ত কমিটির ওই দুই সদস্য গুদামে ঢুকে নমুনা সংগ্রহ করবেন বলে নবান্ন-সূত্রের ইঙ্গিত।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৩০
Share:

বুধবার ঘটনাস্থলে রেল বিকাশ নিগমের কর্তারা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

বিধ্বস্ত উড়ালপুল পরিদর্শনই শুধু নয়। নির্মাতা সংস্থার গুদামেও হানা দেবেন খড়্গপুর আইআইটি-র দুই বিশেষজ্ঞ। ঠিক কী ধরনের মাল-মশলা দিয়ে বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুল তৈরি হচ্ছিল, তার আন্দাজ পেতেই রাজ্য সরকারি তদন্ত কমিটির ওই দুই সদস্য গুদামে ঢুকে নমুনা সংগ্রহ করবেন বলে নবান্ন-সূত্রের ইঙ্গিত। প্রকল্পের মূল হোতা তথা তত্ত্বাবধায়ক কেএমডিএ-র হেফাজতে থাকা এ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিও কমিটি তলব করেছে।

Advertisement

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে পোস্তায় গণেশ টকিজের কাছে নির্মীয়মাণ পথ-সেতুটির একাংশ হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়ায় ২৬ জনের প্রাণ গিয়েছে, আহত অন্তত ৯০। বিপর্যয়ের সম্ভাব্য চারটি কারণ ঘিরে গত সাত দিন ধরে নানা মহলে আলোচনা চলছে। সেগুলো হল: ১) সামগ্রিক নক্‌শার গলদ ২) সেতু ভেঙেছে যে পিলার থেকে, তার নির্মাণগত ও নক্‌শাগত ত্রুটি ৩) ঢালাইয়ে মাঝপথে নাট-বোল্ট খুলে বেরিয়ে এলেও জোড়াতাপ্পি দিয়ে
কাজ চালানো, এবং ৪) নির্মাণ সামগ্রীর নিচু মান।

এ বিষয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সেতু-বিশেষজ্ঞেরা মতামত দিয়েছেন। এ বার আইআইটি-র দুই বিশেষজ্ঞকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে সরকার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছে। সামগ্রিক নক্‌শায় গণ্ডগোল থেকে থাকলে সেতুটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। নক্‌শা পরীক্ষা করার জন্য রাজ্য অবশ্য রেলের সহযোগী সংস্থা রাইটস-কেও ডেকেছে।

Advertisement

এ হেন প্রেক্ষাপটে বুধবার দুপুরে নবান্নে রাজ্যের মুখ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। কমিটির প্রধান তথা রাজ্যের মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও ছিলেন স্বরাষ্ট্র-সচিব মলয় দে, পূর্ত-সচিব ইন্দিবর পাণ্ডে, পূর্ত দফতরের মুখ্য বাস্তুকার মলয় ঘোষ, রাজ্য পুলিশের কর্তা সুরজিৎ করপুরকায়স্থ ও কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমার। সঙ্গে আইআইটি-র দুই বিশেষজ্ঞ— আনন্দপ্রাণ গুপ্ত ও স্বপন মজুমদার। স্থির হয়েছে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওই দুই শিক্ষক ১৩ এপ্রিল প্রাথমিক রিপোর্ট দেবেন। সে দিনই বসবে কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক।

দুই বিশেষজ্ঞ এ দিন নবান্নে আসার আগে পোস্তায় গিয়ে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন। কিছু নমুনাও নেন। প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘ফ্লাইওভারের নক্‌শার মতো নানা নথি আর লালবাজারের তদন্তে উঠে আসা ফরেন্সিক রিপোর্ট-সহ অন্যান্য তথ্য দু’-তিন দিনের মধ্যে ওঁদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কেএমডিএ-র ফাইলও যাচাই করা হবে।’’

বস্তুত বিপর্যয়ের নেপথ্যে নির্মাতা ঠিকাদার সংস্থার পাশাপাশি কেএমডিএ-র ‘ভূমিকা’ও তদন্তকারীদের আতসকাচের তলায়। পুলিশ ইতিমধ্যে কেএমডিএ-র কিছু ইঞ্জিনিয়ারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কেএমডিএ-র কোন কোন ইঞ্জিনিয়ার-অফিসার প্রকল্পটিতে যুক্ত ছিলেন, তার তালিকা তৈরি হয়েছে। নবান্নের এক কর্তার পর্যবেক্ষণ, ‘‘ভাঙনের প্রযুক্তিগত কারণ কিংবা মাল-মশলার মান ইত্যাদি তো দেখা হবেই। পাশাপাশি নজরদারিতে অনিয়ম হয়েছে কি না, তা-ও তদন্ত কমিটির বিলক্ষণ বিচার্য।’’

তদন্তের তোড়জোড় তুঙ্গে উঠলেও ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ঘটনাস্থল পরিষ্কার করার কাজ কিন্তু তিমিরেই। রেল বিকাশ নিগম (আরভিএনএল) রবিবারই পুলিশকে জানিয়েছে, আশপাশের বাড়ি খালি না-হলে কাজে হাত দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ সেটাই করে ওঠা যাচ্ছে না। যেমন, ৪ নম্বর কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটের বাড়ির বাসিন্দা বারোটি পরিবারকে সরে যেতে বলা হলেও তাঁরা সরেননি। ‘‘পুলিশ তো জলদি বাড়ি ফাঁকা
করতে বলেই খালাস! তল্পিতল্পা নিয়ে কোথায় যাব?’’— প্রশ্ন তুলেছেন বাসিন্দারা। ওঁদের সঙ্গে এ দিন দুপুরে এক দফা কথা বলেন ডিসি (সেন্ট্রাল) অখিলেশ চতুর্বেদী। তাঁর কথায়, ‘‘নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা ওঁদের সরতে বলছি বারবার। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পুরসভা করবে।’’

প্রসঙ্গত, পুরসভার তরফে স্থানীয় কমিউনিটি হলকে পরিবারগুলির সাময়িক আস্তানা হিসেবে বাছা হয়েছিল। কিন্তু ৪ কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের বাসিন্দারা সেখানে থাকতে নারাজ। এক ভাড়াটে সুভাষ শর্মার যুক্তি, ‘‘কমিউনিটি হলে সারা ক্ষণ নানা অনুষ্ঠান চলে। ছেলেপুলে, বুড়ো মা-বাবাকে নিয়ে ওখানে থাকব কী করে?’’ শ’খানেক মানুষকে রাখার কোনও পরিকাঠামোই ওখানে নেই বলে ওঁদের দাবি।

অর্থাৎ, কার্যত অচলাবস্থা। শেষমেশ এ দিন সন্ধ্যায় সিইএসসি বাড়িটিতে বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছে। এ দিন সকালে রেল বিকাশ নিগমের কর্তারা ঘটনাস্থলে ঘুরে গিয়েছেন। নিগমের গ্রুপ জেনারেল ম্যানেজার রাজেশ প্রসাদ বলেন, ‘‘তিন সপ্তাহের মধ্যে ভাঙা অংশ সাফ করা হবে।’’

এ দিকে উড়ালপুল-কাণ্ডে তৃতীয় একটি জনস্বার্থ-মামলা এ দিন রুজু হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। কাল, শুক্রবার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি হতে পারে। হাইকোর্টের আইনজীবী রমাপ্রসাদ সরকারের দায়ের করা মামলাটির আবেদনের বক্তব্য: সেতুর পুরোটাই অবিলম্বে ভেঙে দেওয়া জরুরি, কারণ তা ত্রুটিপূর্ণ। দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে রাজ্য যাতে সঠিক তথ্য দেয়, সেই দাবি জানিয়ে আবেদনকারীর আর্জি— মৃতদের পরিজনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে নির্দেশ দিক আদালত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন