Bengali New Year

ধর্ম ছাপিয়ে নববর্ষে বহমান সমন্বয়ের ঐতিহ্য

বিশ্বভারতীর দর্শন ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সংস্কৃতির মধ্যে এই হিন্দু, মুসলিম সীমারেখা টানাই অবান্তর মনে করেন।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:৪৮
Share:

কলকাতাতেই কোনও কোনও উর্দু প্রকাশনা সংস্থাও পয়লা বৈশাখই তাদের হালখাতা উদ্‌যাপন করত। ফাইল চিত্র।

নববর্ষের প্রথম দিনে একদা শেখ সিরাজুদ্দিনের ছাপাখানার কাণ্ড দেখে হেসে গড়াতেন ফিয়ার্স লেনের অবাংলাভাষী পড়শিকুল। সকাল-সকাল মৌলবি ডেকে একটু কোরান পাঠ, তার পরে লাল সুতোয় বাঁধা নতুন খাতায় লেখা, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম! দোয়ার পরে পাড়ায় জনে-জনে আলাউদ্দিনের লাড্ডু বিলোতে ঘুরতেন বাড়ির ছেলেরা। তাতে কলকাতার অবাঙালি মুসলিম বন্ধুদের সকৌতুক প্রশ্ন, আজ কিসের মিষ্টি? তোরা কি হিন্দু না কি! এই নিয়ে কত খুনসুটি! আবার কলকাতাতেই কোনও কোনও উর্দু প্রকাশনা সংস্থাও পয়লা বৈশাখই তাদের হালখাতা উদ্‌যাপন করত।

Advertisement

বিশ্বভারতীর দর্শন ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সংস্কৃতির মধ্যে এই হিন্দু, মুসলিম সীমারেখা টানাই অবান্তর মনে করেন। মুর্শিদাবাদের কান্দিতে তাঁর ছেলেবেলার হাজরাবাটি গ্রামে মুসলিমদের হালখাতাতেও স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলায় হালখাতা শুরুর কথা লিখতে দেখেছেন। আবার হিন্দু বাঙালির পূজ্য হালখাতার নামটিই ফার্সি থেকে আহৃত। অর্থ, নতুন খাতা। সিরাজুলের কথায়, “হালখাতায় কেউ আল্লার নাম লিখতে পারেন, অন্য কিছুও লিখতে পারেন। এ সবই স্থানীয় সংস্কৃতি। একেশ্বরবাদী ইসলাম হালখাতাটি পুজো করতে নিষেধ করবে, কিন্তু নতুন খাতা খোলার উৎসবে সাংস্কৃতিক আচার পালনে কোরান, হাদিসে কোথাও নিষেধ নেই।” তাই গ্রামবাংলায় পয়লা বৈশাখ কোনটা মুসলিম দোকান, কোনটা হিন্দু দোকান চেনা আকছার কঠিন হয়! গাঁদা ফুলের সাজের পাশে আমপাতার সমারোহ, দোকানের দুয়ারে ডাবের শোভা মাঝেমধ্যে মুসলিম দোকানেও ঢুকে পড়ে। সিরাজুলের ব্যাখ্যা, ‘‘বাঙালির আবার মুসলিম, হিন্দু কী! সবটাই বাংলার সংস্কৃতির ছাপ।’’

পাথরপ্রতিমার রাক্ষসখালি দ্বীপের সিএনআই গির্জার পালক (প্যাস্টর) মহীতোষ মাঝি আবার পয়লা বৈশাখ অন্য গুরুদায়িত্বে ব্যস্ত ছিলেন। জিশুর কাছে নতুন বছরে সবার জন্য তিনিই গির্জায় প্রার্থনা করলেন। ক্যাথলিক বা মেথডিস্ট গির্জাতেও এ দিন প্রার্থনার ধূম। সেই সঙ্গে অনেকেই পাশের জি প্লট দ্বীপে চড়কের মেলায় গিয়েছেন! তেল, হলুদ, নিমপাতা বাটায় বলদ-গরুর স্নান বা লাঙলের ফলা ধোয়ায় দ্বীপের খ্রিস্টান, মুসলিমেরাও পিছিয়ে থাকেননি।

Advertisement

আবার নববর্ষের হাত ধরেই বঙ্গজীবনে বঙ্গাব্দের ক্যালেন্ডারের ছোঁয়াচ। লাভপুরের চৌহাট্টা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত হাই স্কুল মাস্টার মুরতাজা হোসেন এই ৮২ বছরেও তাঁর ইমারতি কারবারের দোকানে প্যাকেটে চমচম, ঝুরিভাজা, কেক বিলি করেছেন। খদ্দেরদের সবার হাতে ক্যালেন্ডারও তুলে দেওয়া হল। মুসলিম খদ্দেরের ক্যালেন্ডারে কোনও মসজিদের ছবি থাকতে পারে, হিন্দুদের ক্যালেন্ডারে প্রতিমার মুখ! আবার সুভাষচন্দ্র, নজরুল, রবীন্দ্রনাথের ছবি সবাইকেই দেওয়া যায়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক কাশফ গনিও দেখেছেন বর্ধমানে তাঁদের গ্রামে সুফি পিরবাবার মৃত্যুদিনের উরস, হিজরি নয় বঙ্গাব্দের তারিখ মেনে হয়। কলকাতায় আলপনা, পান্তা, শুঁটকি, পোস্ত, গানবাজনায় পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের সংগঠক ইমানুল হকের অভিজ্ঞতা, জনৈক আত্মীয় সম্প্রতি মাসের ১৫ তারিখ গ্রামের একটি বিয়েয় যেতে বললেন। ইংরেজি মাসের ১৫ তারিখ গিয়ে তিনি শোনেন, সে-বিয়ে বাংলা মাসের ১৫তেই সম্পন্ন।

পঞ্জিকা সম্পাদক চৈতন্যময় নন্দের কথায়, ‘‘বাংলা পাঁজি কিন্তু মুসলিমদের উৎসব, অনুষ্ঠানের দিনক্ষণও সঙ্কলিত করে।” প্রবীণ অধ্যাপক সিরাজুল নিজে বেণীমাধব শীলের ভক্ত। বলছিলেন, “গ্রামের অনেককেই পাঁজি দেখে বিয়ে, চাষবাসের নানা শুভ দিন বলতে হয়! বঙ্গাব্দের গুরুত্ব তাই মোটেও খাটো হয়নি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন