রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমায় ভর্তুকি রাজ্যের

অস্ত্রোপচার আটকে যেতে বসেছিল জহিরুলের। মোমিনপুরের জাহিরুল শেখ স্নায়ুতন্ত্রের জটিল অসুখ নিয়ে গত অগস্ট মাসে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫৩
Share:

অস্ত্রোপচার আটকে যেতে বসেছিল জহিরুলের।

Advertisement

মোমিনপুরের জাহিরুল শেখ স্নায়ুতন্ত্রের জটিল অসুখ নিয়ে গত অগস্ট মাসে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দিনমজুর জাহিরুলের ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা’-র কার্ড ছিল। এই কার্ডে তাঁর বছরে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা নিখরচায় পাওয়ার কথা। কিন্তু যে ধরনের অস্ত্রোপচার তাঁর দরকার তার জন্য সরকারি হাসপাতালেই প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা।

হতদরিদ্র জাহিরুল এই অতিরিক্ত ৪০ হাজার টাকা কোথায় পাবেন? শেষ পর্যন্ত পাড়ার একটি ক্লাব টাকার ব্যবস্থা করায় অস্ত্রোপচার করিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন তিনি।

Advertisement

জাহিরুল না হয় ক্লাবের সহযোগিতা পেয়েছিলেন কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সেটা না-ও হতে পারে। এই দিশেহারা অবস্থা থেকে রোগীদের বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে রাজ্য সরকার এ বার নতুন ছক তৈরি করেছে। ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা’ বা ‘আরএসবিওয়াই’-ভুক্ত দরিদ্র রোগীর অতিরিক্ত চিকিৎসা খরচ তারা এ বার নিজেদের ঘাড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সেটা কী রকম?

আরএসবিওয়াই-এর কার্ড থাকলে এত দিন দারিদ্রসীমার নীচে থাকা একই পরিবারের ৫ সদস্য এক বছরে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিত্‌সা সম্পূর্ণ নিখরচায় পেতেন। রাজ্য সরকারের নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ বার থেকে যদি দেখা যায় রোগীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে কার্ডের ৩০ হাজার টাকা শেষ হয়ে গিয়েছে অথচ চিকিৎসা তখনও অনেকটা বাকি, সে ক্ষেত্রে বাদবাকি খরচ রাজ্য সরকার মেটাবে। অর্থাৎ, এই কার্ডে চিকিৎসা করাচ্ছেন এমন কারও যদি চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকা দরকার হয় তা হলে অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা সরকার দিয়ে দেবে।

নবান্ন সূত্রের খবর, পাইলট হিসেবে কলকাতার পাঁচ মেডিক্যাল কলেজে কিছু দিনের মধ্যেই এই প্রক্রিয়া চালু হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সইয়ের জন্য ফাইল চলে গিয়েছে।

কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য দফতর সব সরকারি হাসপাতালের সব শয্যা ‘ফ্রি’ ঘোষণা করেছে। তার উপরে আরএসবিওয়াই-এ ভর্তুকি দিতে হলে সরকারের উপর কতটা আর্থিক চাপ থাকবে?

নবান্নের একাধিক অফিসার জানিয়েছেন, রাজ্যে এখন বিপিএল তালিকায় থাকা ৬১ লক্ষ পরিবারের কাছে এই কার্ড রয়েছে। অর্থাৎ এই কার্ডের আওতায় রয়েছেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ। ফলে কয়েক কোটি টাকা তো লাগবেই।

তা হলে এই আর্থিক চাপ সরকার নিচ্ছে কেন?

স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, শয্যা ফ্রি হওয়ার জেরে সরকারি হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির রোজগারে যে টান পড়েছে তার থেকে উদ্ধার পেতে এ ছাড়া আর উপায় নেই।

এতদিন পেয়িং বেড, সেখানকার রোগীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা, ডায়েট প্রভৃতি থেকে রোগী কল্যাণ সমিতিতে মাসে কয়েক লক্ষ টাকা আয় হত। এখন তা উঠে যাওয়ায় সমিতির রোজগারের এখন একমাত্র পথ হল রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা-র আওতাভুক্ত রোগীদের চিকিৎসা। কারণ, এঁদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন বিমা সংস্থা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতিকে টাকা দেয়।।

প্রশ্ন উঠেছে, শয্যা এবং অনেক পরিষেবা যদি এমনিতেই নিখরচায় পাওয়া যায় তা হলে মানুষ আরএসবিওয়াই-এর কার্ডের আওতায় সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা নিতে যাবে কেন? আর যদি পরিষেবা না-নেন তা হলে রোগী কল্যাণ সমিতির অবশিষ্ট আয়ও বন্ধ হবে।

আয় বন্ধ হলে সমিতির টাকায় গরিব রোগীদের হাসপাতালে অমিল দামি ইঞ্জেকশন-ওষুধ কেনা থেকে যন্ত্রপাতি সারানো, পাইপ-জেনারেটর মেরামত, হাসপাতাল সাফাইয়ের মতো অনেক কাজ আটকাবে। তাই ‘আরএসবিওয়াই’ কে জনপ্রিয় রাখতে সরকার এই বিমাভুক্তদের এমন কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দিতে চাইছে যাতে মানুষ এই বিমার আওতাতেই চিকিৎসা করাতে ভর্তি হন এবং আরকেএসের রোজগার অক্ষুণ্ণ থাকে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এর জন্য টাকা আসবে কোথা থেকে?

এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, অতিরিক্ত টাকা মেটানো হবে ‘স্টেট ইলনেস অ্যাসিস্ট্যান্স ফান্ড’ থেকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ফান্ডের টাকার জন্য আবেদন করলে তা পেতে মাসের পর মাস গড়িয়ে যাওয়াটাই দস্তুর। সেই ঐতিহ্য বজায় থাকলে আরএসবিওয়াই-এ চলবে কী করে?

স্বাস্থ্যকর্তারা দাবি করছেন, দেরির বিষয়ে তাঁরা ওয়াকিবহাল। তাই যাতে দেরি যাতে না-হয়, তার জন্য এ বার অনলাইন ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোনও হাসপাতালে আরএসবিওয়াই-এর আওতায় ভর্তি কোনও রোগীর টাকার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল অনলাইনে তা সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য ভবনে জানাবে। দিনের দিন সেই টাকা অনুমোদন হয়ে হাসপাতালে চলে আসবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন