অভিভাবকদের প্রতিবাদে ট্যাবলেট বদল

থ্যালাসেমিয়ার সরকারি ওষুধেই আজব উপসর্গ

জেলা বাঁকুড়া, এই স্থানিক অবস্থানের সাদৃশ্য ছাড়াও উষসী-ঋজু-মেঘার মধ্যে মিল হল, তারা সকলেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। আর সকলেই স্বাস্থ্য দফতরের দেওয়া ওষুধ খায়।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:২৮
Share:

প্রতীকী ছবি।

• বাঁকুড়ার প্রতাপবাগানের বছর তেরোর উষসীর সারা গায়ে গত এক মাস ধরে কালশিটে পড়ে যাচ্ছে। হাঁপ ধরে যায় সামান্য হাঁটাচলাতেই।

Advertisement

• বাঁকুড়ারই জয়পুরের ময়নাপুর গ্রামের সাড়ে পাঁচ বছরের ঋজু পাল বেশি ক্ষণ বসে থাকলেও ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। শুয়ে পড়ছে। তারও চোখমুখ-সহ সারা শরীরে কালচে ভাব।

• জয়পুরের সাত বছরের মেঘা ঘোষের আবার শরীর জুড়ে চুলকানির মতো অ্যালার্জি বেরোচ্ছে। পেটে-বুকে ব্যথা। ঘিরে ধরেছে ক্লান্তি।

Advertisement

জেলা বাঁকুড়া, এই স্থানিক অবস্থানের সাদৃশ্য ছাড়াও উষসী-ঋজু-মেঘার মধ্যে মিল হল, তারা সকলেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। আর সকলেই স্বাস্থ্য দফতরের দেওয়া ওষুধ খায়। ওই হাসপাতালের থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অভিভাবক ও চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, আট-ন’মাস আগে পর্যন্ত স্বাস্থ্য দফতরের দেওয়া ওষুধ খেয়ে বাচ্চারা ভালই ছিল। শরীরে লোহা জমার পরিমাণ কমে গিয়েছিল অনেক। কিন্তু ২০১৬-র নভেম্বর থেকে অন্য সংস্থার ‘আয়রন কিলেশন ট্যাবলেট’ দেওয়া শুরু হয়। সেই ওষুধ খেয়ে উপকার তো হচ্ছেই না। উপরন্তু শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে ভীষণ ভাবে। মিল আছে অসুস্থতার উপসর্গে, অমিলও অনেক।

সরকারি ওষুধের মান নিয়ে সরব হয়েছেন ওই রোগীদের অভিভাবকেরা। তাঁদের সম্মিলিত প্রতিবাদপত্র ও ক্ষোভের জেরে থ্যালাসেমিয়া ইউনিটে সেই সরকারি ওষুধ বন্ধ করে আপাতত বাজার থেকে ওষুধ কিনে দিচ্ছে বাঁকুড়া সরকারি মেডিক্যাল কলেজ।

ওই মেডিক্যাল কলেজের থ্যালাসেমিয়া ইউনিটে নথিভুক্ত প্রায় ৩০০ শিশু-কিশোরের অনেকের অভিভাবকই বেসরকারি সংস্থায় ছেলেমেয়েদের ‘সেরাম ফেরিটিন লেভেল টেস্ট’ করিয়েছেন। তাতে দেখা গিয়েছে, তাদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লোহা জমছে বেশি মাত্রায়। হেমাটোলজিস্টেরা জানান, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয় এবং তার জেরে তাঁদের হৃদ্‌যন্ত্র, যকৃৎ, পিটুইটারি গ্রন্থির মতো অনেক জায়গায় লোহা জমে। সেই লোহা দূর করতে টানা ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওষুধ না-খেলে বা ওষুধের মান খারাপ হলে হৃদ্‌যন্ত্র বা যকৃৎ বিকল হয়ে মৃত্যু হয় অল্প বয়সেই।

২০ নভেম্বর রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বিভাগে চিঠি দেন বাঁকুড়ার ৩৫ শিশু-কিশোর রোগীর অভিভাবকেরা। চিঠি দেওয়া হয় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধানকেও। চিঠিতে তাঁরা অনুরোধ করেন, ওই আয়রন কিলেশন ট্যাবলেট প্রত্যাহার করে নিয়ে অবিলম্বে যেন নতুন কোনও ট্যাবলেট দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য দফতরের থেকে সেই চিঠির জবাব আসেনি। বাঁকুড়া মেডিক্যালের কর্তৃপক্ষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছেন। ‘‘এটা শিশু ও কিশোর রোগীদের জীবনের প্রশ্ন। কোনও ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে না। আমরা সরকারের সরবরাহ করা আয়রন কিলেশন ট্যাবলেট বন্ধ করে দিয়েছি গত ২৩ নভেম্বর থেকে। নিজেরা অন্য সংস্থার ওষুধ কিনে রোগীদের দিচ্ছি। তদন্তেরওব্যবস্থা হয়েছে। যে-ট্যাবলেট এত দিন দেওয়া হতো, তার নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে,’’ বললেন কলেজের অধ্যক্ষ পার্থবাবু।

সরকারি হাসপাতালের ফার্মাসি ও ন্যায্য মূল্যের দোকানের ওষুধের মান নিয়ে আগে অভিযোগ উঠেছে বহু বার। কিন্তু বাঁকুড়ার মতো সম্মিলিত ভাবে সই করে চিঠি দিয়ে সরকারি ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার নজির বিশেষ নেই। উষসীর বাবা মানস মুখোপাধ্যায়, মেঘার বাবা রঘুনাথ ঘোষের অভিযোগ, ‘‘মাঝেমধ্যেই ওষুধের জোগান থাকে না। যতটুকু পাওয়া যায়, তারও মান যদি খারাপ হয়, আমরা গরিবেরা বাচ্চাগুলোকে বাঁচাব কী করে? প্রতি মাসে বাজার থেকে ৩-৪ হাজার টাকার ওষুধ কেনার ক্ষমতা নেই আমাদের।’’

বিক্ষিপ্ত ভাবে একই অভিযোগ পেয়েছেন অন্যান্য মেডিক্যালের থ্যালাসেমিয়া ইউনিটের ডাক্তারেরা। তবে সম্মিলিত প্রতিবাদ হয়নি বলে বিষয়টি এত দিন জানাজানি হয়নি। এমনটা হল কেন? মন্তব্য করতে চাননি রাজ্য থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত দীপা বসু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন