— প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নিজের বা পরিবারের কারও নাম নেই? নাম না থাকলে নথি লাগবে। নাম থাকলে কোনও নথির দরকার নেই। ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের জন্য ১৩টি নথির উল্লেখ করেছে নির্বাচন কমিশন। তারা জানিয়েছে, ২০০২ সালের তালিকার সঙ্গে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া না গেলে ওই ১৩টি নথির যে কোনও একটি দিতে হবে। শুনানি করে সেই নথি খতিয়ে দেখা হবে। তার পরেই নতুন ভোটার তালিকায় সংশ্লিষ্ট ভোটারের নাম নথিভুক্ত হবে। মঙ্গলবার থেকে ‘এনুমারেশন ফর্ম’ নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাবেন বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও)-রা। ফলে ২০০২ সালের তালিকায় যাঁদের নাম নেই, সেই ভোটারেরা নথি নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন। তাঁরা নথি সংগ্রহে নেমেও পড়েছেন। যদিও ১৩টি নথির মধ্যে বেশ কয়েকটি নিয়ে সমস্যা রয়েছে। কোথায়, কী ভাবে, কার কাছে গেলে ওই সব নথি পাওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে হদিস দিচ্ছে আনন্দবাজার ডট কম।
কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র, পেনশন পেমেন্ট অর্ডার
কমিশনের বেঁধে দেওয়া নথির তালিকায় প্রথমেই আছে কেন্দ্র অথবা রাজ্য সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র, পেনশন পেমেন্ট অর্ডার (পিপিও)। রাজ্য অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী হলে ওই নথি পাওয়া সম্ভব। স্থায়ী ভাবে কাজ করছেন অথবা অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের কাছে ওই নথি থাকার কথা। চাকরিতে যোগদান বা অবসরের সময় কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এই নথি কর্মীদের দেন। অর্থাৎ, সরকারি কর্মী বা প্রাক্তন সরকারি কর্মীদের কাছে এই নথি থাকবে।
১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগের নথি
কমিশন জানিয়েছে, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের সিলমোহর দেওয়া যে কোনও নথিই এসআইআরে গ্রহণ করা হবে। এমনকি, ওই সময়ের আগে কেউ এলআইসি-র নথিপত্রও দেখাতে পারেন। কমিশনের বক্তব্য, ওই সংক্রান্ত নথি সংশ্লিষ্ট ভোটারের কাছে আগে থেকেই রয়েছে। কারণ, এখন এই ধরনের নথি তৈরি করা বা জোগাড় করা সমস্যার। যদিও কারও কাছে ওই নথি না থাকলে উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এই নথিও পাওয়া সম্ভব।
জন্মের শংসাপত্র
যে এলাকায় জন্ম, সেই এলাকার পঞ্চায়েত বা পুরসভায় জন্মের শংসাপত্রের (বার্থ সার্টিফিকেট) জন্য আবেদন করতে হবে। পঞ্চায়েত এলাকায় বিডিও হয়ে মহকুমাশাসকের কাছে আবেদন জমা পড়ে। তাঁর দফতর থেকে ওই শংসাপত্র দেওয়া হয়। এখন অনলাইনেও আবেদন করা যায়। তবে জন্মের শংসাপত্র নিতে গেলে বাবা এবং মায়ের সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে।
পাসপোর্ট
এসআইআরে নাগরিকত্বের ‘প্রাথমিক প্রমাণ’ হিসাবে পাসপোর্টকে ধরা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশ মন্ত্রক দেশের নাগরিকদের পাসপোর্ট দেয়। প্রতিটি রাজ্যে পাসপোর্টের কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। সেখানে গিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হয়। অনলাইনেও আবেদন করা যায়। পাসপোর্ট দেওয়ার আগে থানা থেকে পরিচয় যাচাই করা হয়। নথি এবং তথ্যের গেরোয় এই প্রক্রিয়াটি তুলনামূলক ভাবে একটু জটিল। তথ্য বলছে, এ রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও কম মানুষের পাসপোর্ট রয়েছে।
শিক্ষাগত শংসাপত্র
এসআইআরে নথি হিসাবে মাধ্যমিক বা তার বেশি শিক্ষাগত শংসাপত্রকে ধরা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই শিক্ষাগত শংসাপত্র দেওয়া হয়। এই নথি পাওয়া কঠিন নয়। যাঁরা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা তার বেশি পড়াশোনা করেছেন, সকলের কাছেই এই নথি থাকার কথা। না থাকলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
স্থায়ী বাসিন্দা শংসাপত্র
স্থায়ী বাসিন্দা শংসাপত্র বা ‘ডোমিসাইল সার্টিফিকেট’ হল এমন একটি সরকারি নথি, যা প্রমাণ করে কোনও ব্যক্তি কোনও রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কি না। এই শংসাপত্র সাধারণত তহসিলদার, জেলাশাসক বা মহকুমাশাসকের অফিস থেকে দেওয়া হয়। কোনও জনপ্রতিনিধি, অর্থাৎ এলাকার কাউন্সিলর বা বিধায়ক এই শংসাপত্র দিতে পারেন না। এই শংসাপত্রের জন্য আবেদন করতে সাধারণত স্কুলের সার্টিফিকেট, জন্ম সার্টিফিকেট, রেশন কার্ড এবং ঠিকানার প্রমাণ হিসাবে জমির দলিলের মতো নথি প্রয়োজন। অনেক জায়গায় অনলাইনেও এই শংসাপত্রের জন্য আবেদন করা যায়।
বনাধিকার শংসাপত্র
বনাধিকার শংসাপত্র (ফরেস্ট রাইটস সার্টিফিকেট) জেলাস্তরের কমিটি (ডিএলসি) অর্থাৎ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসক দেন। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওই শংসাপত্র পাওয়া যায়। প্রথমে কোনও ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে গ্রামসভায় আবেদন করতে হয়। সেই আবেদন যায় মহকুমা স্তরের কমিটির কাছে। মহকুমা স্তরের কমিটি পুরো বিষয়টি যাচাই করে সুপারিশপত্র পাঠায় জেলাশাসকের কাছে। সমস্ত ঠিক থাকলে ওই শংসাপত্র ‘জমির মালিকানা’ বা ‘পাট্টা’ হিসাবে দেওয়া হয়। তবে য়ে কেউ এই শংসাপত্রের জন্য আবেদন করতে পারেন না। বনাঞ্চলে বসবাসকারী তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য ‘ঐতিহ্যবাহী’ বনবাসীরা এই শংসাপত্র পাওয়ার যোগ্য। এই শংসাপত্র পাওয়ার অন্যতম শর্ত, ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বরের আগে জীবিকার প্রয়োজনে বনভূমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করতে হবে। সেই শর্ত পূরণ না হলে এই নথি মিলবে না।
জাতিগত শংসাপত্র
তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) মানুষদের জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া হয়। এলাকার বিডিও মারফত মহকুমাশাসকের কাছে আবেদনপত্র জমা পড়ে। তিনি সব খতিয়ে দেখে এই শংসাপত্র দেন। অনলাইনে বা অফলাইনে জাতিগত শংসাপত্রের জন্য আবেদন করা যায়। প্রথমে পঞ্চায়েত বা পুরসভায় আবেদন করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া এই শংসাপত্র পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এই শংসাপত্র পেতে পূর্বপুরুষদের নাম বা বংশতালিকাও দিতে হয়।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নাম
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-তে নাম থাকলে সেই এসআইআরে জন্য নথি হিসাবে গণ্য করা হবে। অসমে এনআরসি হয়েছে। সেই নথিও এই রাজ্যে ব্যবহার করা যাবে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্যে নাগরিকত্বের এই নথি নেই। ফলে অসমের যোগসূত্র না থাকলে বাংলার এসআইআরের ক্ষেত্রে এই নথির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বংশলতিকার শংসাপত্র
বংশতালিকার নথি গ্রামীণ এলাকায় গ্রাম পঞ্চায়েত এবং শহরাঞ্চলে পুরসভার অফিসে সংরক্ষিত থাকে। সেখানে গিয়েই আবেদন করতে হয়। এই নথি পাওয়ার জন্য ঠিকানার প্রমাণপত্র, পরিচয়পত্র এবং পরিবারের সদস্যদের তালিকা জমা দিতে হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককে ‘ট্রি’ আকারে বংশের তালিকা বোঝাতে হয়। তিনি সন্তুষ্ট হলে এই শংসাপত্র প্রদান করেন।
সরকারের দেওয়া জমির নথি
সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য নয়, এমন জমির ক্ষেত্রে এই শংসাপত্র দেওয়া হয়। কোনও ব্যক্তির জমি বা বাড়ির অধিকারের জন্য শংসাপত্র দেয় সরকার। ‘ই-সম্পদ’ পোর্টালে আবেদন করে এই শংসাপত্র পাওয়া যায়।
আধার কার্ড
আধার কার্ড পরিচয়পত্রের প্রমাণ। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে বিদেশি নাগরিকেরাও আধার কার্ড তৈরি করতে পারেন। এটি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ‘পরিচয়পত্র’ হিসাবে এই নথি নিতে বলেছে। সেই মতোই নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আধার কার্ডের সঙ্গে নির্দিষ্ট অন্য ১২টি নথির মধ্যে যে কোনও একটি দিতে হবে। আধার কার্ড দিয়ে আবেদন করা গেলেও ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত হবে না।
বিহারের এসআইআর নথি
নিবিড় সংশোধনের ১৩ তম নথিতে রয়েছে বিহারের এসআইআর। এসআইআর করে সেখানে আগেই ভোটার তালিকায় নাম ঝাড়াই-বাছাই হয়েছে। সেই তালিকারও ভূমিকা আছে পশ্চিমবঙ্গের এসআইআরের ক্ষেত্রে। যেমন, কেউ পশ্চিমবঙ্গের ভোটার অথচ এ রাজ্যের ২০০২ সালের তালিকার সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু বিহারের নতুন তালিকায় তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম রয়েছে। কমিশন মনে করছে, ওই ব্যক্তি ভারতের নাগরিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের ভোটার হিসাবে তাঁর নাম নথিভুক্ত করাতে পারবেন। তাই পশ্চিমবঙ্গের কোনও ভোটারের পরিবারের কারও নাম বিহারের তালিকায় থাকলেও তা নথি হিসাবে গ্রহণের কথা জানিয়েছে কমিশন।
এসআইআরে কমিশন আধার কার্ড-সহ এই ১৩টি নথির উল্লেখ করেছে। একই সঙ্গে তারা জানিয়েছে, এর বাইরেও কোনও নথি বা তথ্য ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পারলে তা-ও গ্রহণ করা হবে। কমিশনের ব্যাখ্যা, ২০০২ সালের তালিকায় নিজের অথবা বাবা-মায়ের নাম থাকলে কোনও নথিই দিতে হবে না। কোন বুথে নাম রয়েছে, বিএলও-কে সেই তথ্য দিয়ে ‘এনুমারেশন ফর্মে’ আবেদন করলেই সংশোধিত ভোটার তালিকায় নাম উঠে যাবে। ২৩ বছর আগের তালিকায় নাম না থাকলে উপরে উল্লিখিত ১৩টির মধ্যে একটি নথি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে শুধু নথি জমা দিলেই হবে না, নথি জমা পড়ার পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ডেকে পাঠিয়ে তা যাচাইও করতে পারেন ইআরও-রা। তাঁরা সন্তুষ্ট হলেই চূড়ান্ত তালিকায় নাম উঠবে।