ভোটের অঙ্কের হিসেব পাটিগণিতের নিয়মে সবটা কষা যায় না। কিন্তু তাতে লঘুও হয় না পাটিগণিতের গুরুত্ব। এ রাজ্যে শেষ দুটো পূর্ণাঙ্গ (অর্থাত্ গোটা রাজ্যের) নির্বাচন হল ২০১১ সালের বিধানসভা ভোট আর ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট। ২০১১তে তৃণমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেসের মধ্যে জোট ছিল। সেই ভোটের ফলাফলের হিসেব থেকে দলভিত্তিক জনসমর্থনের পাটিগাণিতিক হিসেব কষা মুশকিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ভোটে তৃণমূল, বামফ্রন্ট (দল না হলেও বহু বছর ধরে এক সঙ্গে লড়ছে), কংগ্রেস আর বিজেপি আলাদা আলাদা লড়ায় ফল বিশ্লেষণটা অনেক সরল সমীকরণে করা সম্ভব। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এটাই এ রাজ্যে ২০১৬র বিধানসভা ভোটের আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ ভোট। অর্থাত্ সব থেকে কাছাকাছি ভোটের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে ২০১৪র লোকসভা নির্বাচন থেকেই।
৩৪/৪২, কিন্তু...
২০১৪ সালে রাজ্যের ৪২টা লোকসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস একাই পেয়েছিল ৩৪টা আসন (কাকতালীয় ভাবে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের সঙ্গে সংখ্যাটা মিলে গেছে)। মোট আসনের ৭৭ শতাংশ ছিল তৃণমূলের দখলে। কিন্তু মোট প্রাপ্ত ভোটের অঙ্কটা রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে আদৌ উল্লসিত হওয়ার মতো নয়।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে কার কত ভোট
তৃণমূল ৩৯.৮ শতাংশ
বামফ্রন্ট ২৯.৯ শতাংশ
কংগ্রেস ০৯.৭ শতাংশ
বিজেপি ১৭ শতাংশ
সারণি ১
দেখাই যাচ্ছে ৭৭ শতাংশ আসন পেলেও তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৪০ শতাংশের কম। অর্থাত্ ৬০ শতাংশের বেশি ভোট বিরোধী তিন পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়াটাই ছিল তৃণমূলের ‘বিপুল’ সাফল্যের চাবিকাঠি। আর এই অঙ্কই আসন্ন বিধানসভা ভোটে বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষে সবচেয়ে বড় সওয়াল।
বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের ভোট মিললে ২০১৪-র হিসেব
তৃণমূল ৩৯.৮ শতাংশ
বামফ্রন্ট+কংগ্রেস ৩৯.৬ শতাংশ
বিজেপি ১৭ শতাংশ
সারণি ২
তৃণমূল আর বাম-কংগ্রেসের যৌথ ভোট ছিল প্রায় সমান সমান। দুপক্ষের ঝুলিতেই প্রায় ৪০ শতাংশ। বাকি রইল বিজেপির হাতে থাকা ১৭ শতাংশ ভোট যা আসলে এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে যাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, বিজেপির ভোট এ বার অনেকটা কমবে, এবং সেই ভোট বেশিটাই পড়বে অন্যান্য বিরোধী দলের পক্ষে।
জোট ফ্যাক্টর
বিজেপির ২০১৪ সালে পাওয়া ভোটের বড় অংশ এ বার বাম বা কংগ্রেসের পক্ষে গেলে কী হতে পারে তার হিসেবে আমরা আসব। তার আগে দেখে নেবো শুধু বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের ভোট মিললে লোকসভা ভোটের বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফল কেমন হত। এমনিতে ২০১৪র লোকসভা ভোটে রাজ্যের ২৯৪টা বিধানসভা আসনের মধ্যে ২১৪টাতেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল।
২০১৪-র বিধানসভা ভিত্তিক ফল
ক’টা আসনে এগিয়ে কত শতাংশ ভোট
তৃণমূল ২১৪ ৩৯.৮
বামফ্রন্ট ২৮ ২৯.৯
কংগ্রেস ২৮ ৯.৭
বিজেপি ২৪ ১৭
সারণি ৩
এ বার দেখে নিই বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের ভোটটা মিললে এই ফলাফল কেমন হত।
২০১৪-র বিধানসভা ভিত্তিক ফল
কত আসনে এগিয়ে কত শতাংশ ভোট
তৃণমূল ১৮১ ৩৯.৮
বামফ্রন্ট+কংগ্রেস ৯৮ ৩৯.৬
বিজেপি ১৫ ১৭
সারণি ৪
অর্থাত্ বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস আলাদা লড়ে যেখানে মোট ৫৬টা বিধানসভা আসনে এগিয়েছিল, সেটাই এক সঙ্গে লড়লে ৯৮টা হতে পারত। তৃণমূল আর বিজেপির এক যোগে চূড়ান্ত সাফল্যের সময়েও।
সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষা কী বলছে
ভোটের দিন ক্ষণ ঘোষণার আগেই জনমত সমীক্ষা করেছিল এপিবি আনন্দ এবং এসি নিয়েলসন। আরও কয়েক দফায় এই সমীক্ষা চলবে। প্রথম সমীক্ষা যে হিসেব দিচ্ছে তাতে তৃণমূল জিতলেও ১০০র বেশি আসন পাবে বিরোধী জোট।
বিধানসভা ভোট ২০১৬
এবিপি আনন্দ এবং এসি নিয়েলসনের জনমত সমীক্ষার ফল
তৃণমূল ১৮২
বামফ্রন্ট+কংগ্রেস ১০৭
বিজেপি ০
অন্যান্য ৫
সারণি ৫
ফ্যাক্টর হবে বিজেপির ভোট
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপি ২০১৪ সালে মোদী হাওয়ায় যে ভোট পেয়েছিল এ বার তা অনেকটা কমবে। এমনকী বিজেপির ভোট তিন ভাগের এক ভাগেও নেমে আসতে পারে, বলছেন অনেকে। তা হলে বিজেপির থেকে বেরিয়ে যাওয়া ভোট কোথায় যাবে? রাজ্য সিপিএম এবং প্রদেশ কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতার মতে, অ্যান্টি-পাওয়ার (ক্ষমতা বিরোধী) ভোটের একটা বড় অংশ টেনে নিয়ে গিয়েছিল মোদী ঢেউ। তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে গিয়ে এই ভোটাররা সিপিএম বা কংগ্রেসের উপর আস্থা না রেখে বিকল্প হিসেবে বিজেপিকেই বেছে নিয়েছিলেন। পাশাপাশি অনেক জায়গাতেই বাম কর্মী সমর্থকদেরও একটা অংশ বিজেপির ছাতার তলায় আশ্রয় খুঁজতে শুরু করেছিলেন। অর্থাত্ বিজেপি যে অতিরিক্ত ভোট পেয়েছিল তা মূলত শাসক দল বিরোধী ভোট। কংগ্রেস এবং সিপিএম নেতাদের আশা, সেই ভোটারদের অধিকাংশই এ বার বিজেপির থেকে সরে আসবেন, কিন্তু ভোটটা দেবেন তৃণমূলের বিপক্ষেই।
বিজেপির ভোট কাটলে কী হবে
এ বার বিজেপির ভোটের হিসেবটায় আসা যাক। এটাই আগামী বিধানসভা ভোটে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সোজা হিসেবে বোঝা যাচ্ছে, বিজেপির থেকে বেরিয়ে যাওয়া ভোট যদি প্রায় সমানে সমানে শাসক এবং প্রধান বিরোধী শিবিরে ঢোকে তবে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট হলেও তৃণমূল ভাল ভাবে জিতবে। কিন্তু না হলে? না হলে কিন্তু হিসেবটা তৃণমূলের পক্ষে স্বস্তির নয় একেবারেই।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, খুব বেশি হলে বিজেপি তার ২০১৪র ভোটের ৩৫ শতাংশ ধরে রাখতে পারবে। বিজেপির বাকি ৬৫ শতাংশ ভোট ভাগাভাগি হবে শাসক আর অন্যান্য বিরোধীদের মধ্যে। সিপিএম-কংগ্রেস জোটপন্থীদের কারও কারও মতে, বিজেপির এই ৬৫ শতাংশ ভোটের ৯০ শতাংশই জোটের পক্ষে যাবে।
আমরা কয়েকটা সম্ভাব্য হিসেব ধরে দেখব বিজেপির ভোট কোন দিকে কত গেলে কী হতে পারে তার ফলাফল।
সম্ভাবনা ১
যদি বিজেপির ভোটের ৪০ শতাংশ জোটের পক্ষে যায় ২৫ শতাংশ ভোট তৃণমূলের পক্ষে যায়
সম্ভাবনা ২
যদি বিজেপির ভোটের ৪৫ শতাংশ জোটের পক্ষে যায় ২০ শতাংশ ভোট তৃণমূলের পক্ষে যায়
উপরের দুটো (৬ এবং ৭ নং) সারণির মধ্যে একটা ‘অদ্ভুত’ ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দুটো ক্ষেত্রেই বাম-কংগ্রেসের মোট ভোট তৃণমূলের ভোটের থেকে বেশি। অথচ আসন সংখ্যায় এগিয়ে তৃণমূল। কেন এমন হল? এর উত্তর খোঁজার আগে ৪ নং সারণির তথ্যটাও আর এক বার মনে করাবো। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল আর বাম-কংগ্রেস যৌথ ভোট ছিল প্রায় সমান সমান। কিন্তু বাম-কংগ্রেস ভোট মিললেও তারা এগিয়ে মাত্র ৯৮টা আসনে। যেখানে প্রায় সমান ভোট পেয়ে তৃণমূল লিড করছে ২১৪টা আসনে। মোট প্রাপ্ত ভোট আর মোট প্রাপ্ত আসনের এই বিষম সম্পর্কটাও কিন্তু লুকিয়ে আছে পাটিগণিতের হিসেবেই। হিসেবটা মিলবে কংগ্রেসের পাওয়া ভোটের মধ্যে। ২০১৪র লোকসভা ভোটে কংগ্রেস এ রাজ্যে ভোট পেয়েছিল ৯.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৫.৬ শতাংশ ভোট উত্তরবঙ্গ এবং মুর্শিদাবাদের ৭৬টা আসনে পাওয়া। বাকি ২১৮টা আসনে ৪.১ শতাংশ ভোট পায় কংগ্রেস। অর্থাত্ কংগ্রেসের ভোট ঘনত্ব উত্তরবঙ্গের তুলনায় দক্ষিণবঙ্গে নগন্য। এই কারণেই দক্ষিণবঙ্গে বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের ভোট মিললেও তৃণমূলের কিছুই প্রায় আসবে যাবে না। দরকার বিজেপির আরও ভোট কাটা।
সম্ভাবনা ৩
যদি বিজেপির ভোটের ৫০ শতাংশ জোটের পক্ষে যায় ১৫ শতাংশ ভোট তৃণমূলের পক্ষে যায়
পাহাড়ের তিনটে আসন বাদ দিয়ে রাজ্যের বাকি ২৯১টা আসনে বিজেপির ৬৫ শতাংশ ভোট তিন ভাবে ভাগাভাগি করে কষা হয়েছে উপরের তিনটে সারণির হিসেব। এই হিসেব থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল ৭৭ শতাংশ বিধানসভা আসনে এগিয়ে থেকেও প্রাপ্ত ভোটের অঙ্কটা তাদের পক্ষে বেশ অস্বস্তির। বামফ্রন্ট, কংগ্রেসের আসন সমঝোতা এই অস্বস্তিকে দুশ্চিন্তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কারণ ক্ষমতা বিরোধী ভোট ‘জোট’এ উত্সাহিত হয়ে যত বেশি এককাট্টা হবে তত বিপদ তৃণমূলের। এ হিসেব আমরা দেখলাম। ফলে শাসক দলের প্রধান লক্ষ্য বা চাহিদা এখন একটাই। তা হল বিজেপি তার ভোট যতটা সম্ভব ধরে রাখুক। বিজেপি নিজের ভোট যত বেশি ধরে রাখতে পারবে, তৃণমূলের তত লাভ। ভোট কাটাকাটির অঙ্কে পার হয়ে যাবে ক্ষমতার বৈতরণী।
শেষ পর্যন্ত ভোটের ফল যাই হোক, অঙ্কের হিসেবে একটা উত্তেজনাময় ভোটের সাক্ষী হতে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ এতে কোনও সন্দেহ নেই। এবং এ বারের বিধানসভা ভোটে স্বার্থের বিচারে কার্যত দুটো পক্ষ। এক দিকে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস। অন্য দিকে তৃণমূল আর বিজেপি। বাম-কংগ্রেসের পক্ষটা প্রকাশ্য এবং স্পষ্ট। কিন্তু ভোটের অঙ্কে তৃণমূল আর বিজেপির স্বার্থের ঐক্যটা সে ভাবে সামনে আসেনি। বিজেপি নিজের ভোট কতটা ধরে রাখতে পারবে সেটা এ রাজ্যে তার রাজনৈতিক অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে। এবং বিজেপি কতটা ভোট ধরে রাখতে পারবে, তৃণমূলের ক্ষমতায় ফেরা বা না ফেরার সঙ্গেও তা জড়িয়ে। ভীষণ ভাবে।