ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই হল!
কুকথার জন্য দু’দিন আগেই ডেপুটি স্পিকারকে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়েছিল বিরোধী দলনেতার কাছে। সেই পদে থেকেই বেফাঁস মন্তব্য করে ফের বিতর্কে জড়ালেন সোনালি গুহ! এ বার আর কুকথা নয়। তবে এ বার একসঙ্গে জোড়া অস্বস্তি! প্রথমত, স্পিকারের আসনে বসে বিরোধী বিধায়কের উদ্দেশে পাল্টা রাজনৈতিক কটাক্ষ। এবং দ্বিতীয়ত, ঝোলা থেকে একেবারে বেড়াল বার করে ফেলা!
কী করেছেন সোনালি? প্রথমার্ধের অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে অল্প কিছু ক্ষণের জন্য বিধানসভা পরিচালনার ভার পেয়েছিলেন ডেপুটি স্পিকার। তার মধ্যেই ঘটে গেল বিপত্তি! তখন চলছিল জিরো আওয়ার। সিপিএমের বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় আসানসোল পুর-নিগমের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বলছিলেন। বিধায়কের বক্তব্য ছিল, আসানসোলের ভোটের আগে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমের মতো জেলা থেকে লোক জড়ো করছে শাসক দল। ভোটের সময় বাইরের দুষ্কৃতীদের এনে গোলমাল বাধানোর পরিকল্পনা হচ্ছে বলে তাঁদের আশঙ্কা। ভোটের দিন এলাকার মানুষ যাতে সুষ্ঠু ভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, প্রশাসনকে সে দিকে নজর রাখার আর্জি ছিল বিধায়কের। জিরো আওয়ারে যে কোনও বিধায়ক যে কোনও বিষয়ই তুলতে পারেন। তার উপরে কোনও বক্তব্য জরুরি নয়। কিন্তু স্পিকারের আসনে বসে সোনালি এ দিন মুখ খুললেন। এবং চমকে দিলেন সভায় হাজির সকলকে!
সিপিএমের গৌরাঙ্গবাবুর উদ্দেশে সোনালির মন্তব্য, ‘‘আসলে কী জানেন, এই বাইরে থেকে লোক এনে ভোট করা আপনারাই শিখিয়েছেন! হিস্ট্রি রিপিট্স ইটসেল্ফ!’’ শাসক শিবিরের সদস্যেরা তখন হতচকিত! আর বিরোধী বেঞ্চের সদস্যেরা সহাস্যে গুঞ্জন শুরু করেছেন। কারণ, পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শিখে বর্তমান শাসক দলও একই দাওয়াই প্রয়োগ করছে, এই ‘সত্য কবুল’ করে ফেলেছেন সোনালি! সম্ভবত নিজের অজান্তেই!
শিক্ষায় দলতন্ত্রের মতো কিছু বিষয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের পাঠশালারই কৃতী ছাত্রী, গত চার বছরে এই কথা বারবারই উঠে এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। বর্তমান শাসক দলের দিকে ভোটের সময় গা-জোয়ারির অভিযোগ তুলে অনেকেই বলেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে গুরুমারা বিদ্যায় মমতার দল পূর্বসূরিদেরও ছাপিয়ে গিয়েছে! কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব কখনওই সে কথা মানেননি। তাঁদের বরাবরের অবস্থান, ও সব ৩৪ বছরে হতো! সোনালিই প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে বলে ফেললেন, বামেদের দেখানো পথেই তাঁরা চলছেন! তা-ও আবার স্পিকারের আসনে বসে, যেখানে বসে রাজনৈতিক মন্তব্য সমীচীন নয় বলেই মনে করেন পরিষদীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞেরা। ডেপুটি স্পিকারের এই মন্তব্যের কথা শুনে বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম যেমন বলেছেন, ‘‘ওই আসনে বসে এ ধরনের মন্তব্য করা উচিত নয়। স্পিকারের আসনকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়।’’ বর্তমান স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, সোনালি কী বলেছেন, বিধানসভায় সেই তথ্য না দেখে কোনও মন্তব্য করতে চান না। তবে শাসক শিবির সূত্রের খবর, সোনালির মন্তব্য নিয়ে হইচই পড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে বাদই যেতে পারে ওই অংশ।
বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলে নিজেদের দিকেও সোনালি আঙুল ঘুরিয়ে নেওয়ায় বিরোধী শিবির ক্ষুব্ধ হয়েও একই সঙ্গে উৎসাহিত! বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, ‘‘উনি কখন কী বলেন, কোনও ঠিক নেই। স্পিকারের আসনে বসে এ সব বলা যায় না। তবে এত দিন ৩৪ বছর, ৩৪ বছর বলে এসে এখন আবার একটু অন্য রকমও বলছেন!’’ সভা পরিচালকের আসনে বসে এমন মন্তব্য অবাঞ্ছনীয় বলে উল্লেখ করেও কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া বলছেন, ‘‘সোনালিদেবীকে ধন্যবাদ জানাই। সারল্যের জন্য সত্যি কথাটা বলে দিয়েছেন! বুঝিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূল দখলদারির রাজনীতিই করছে। এর পরে আর মুখ্যমন্ত্রী যেন আগের জমানার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা না করেন!’’ আর বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘যা বলার, সোনালিই তো বলে দিয়েছেন!’’
তৃণমূলের পরিষদীয় নেতৃত্ব অবশ্য এই বির্তকে মুখ খোলেননি। তবে শাসক দলের অন্দরে অনেকেই ডেপুটি স্পিকারের ‘স্বীকারোক্তি’তে বিশেষ বিস্মিত নন। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘সাতগাছিয়া থেকে পরের বার বিধানসভার টিকিট পাবে কি না, চিন্তায় আছে সোনালি। তার থেকেই মনে হয় বারবার লাগাম ছুটে যাচ্ছে!’’ সভার বাইরে শাসক পক্ষেরই এক বিধায়কের সহাস্য টিপ্পনি, ‘‘উনি যে আরও কিছু বলে ফেলেননি, এটাই বিরাট সৌভাগ্য!’’
একই দিনে আর এক প্রস্ত অস্বস্তিও সামলাতে হয়েছে শাসক শিবিরকে। জেল নিয়ে প্রশ্নোত্তর চলাকালীন সিপিএমের গৌরাঙ্গবাবুই প্রশ্ন করে বসেন, জেলের মধ্যে বন্দিরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছেন, জেলের নিরাপত্তারক্ষী বা কর্ত়ৃপক্ষকে আক্রমণ করছেন, কেউ আত্মহত্যা করছেন, আবার কেউ মন্ত্রিগিরি করছেন! জেলে থেকে কী কী করা যায়, মন্ত্রীর কাছে জানতে চান তিনি! ইঙ্গিত স্পষ্টতই মন্ত্রী মদন মিত্রকে জড়িয়ে। কারামন্ত্রী হায়দর আজিজ সফি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! স্পিকার বিমানবাবু তাঁর আসন থেকে ব্যাখ্যা দেন, দেশে এখন মোট বন্দিদের দুই-তৃতীয়াংশই বিচারাধীন। আর এক-তৃতীয়াংশ সাজাপ্রাপ্ত। কেন্দ্রীয় সরকার নতুন জামিন বিল আনছে বিচারাধীন অবস্থায় দীর্ঘ দিন বন্দিদশা থেকে অব্যাহতি দেওয়ানোর লক্ষ্যেই।
মন্ত্রী মদনকে কেন বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে, সেই প্রশ্ন তুলে প্রচার চালাচ্ছেন তাঁর অনুগামীরা। বিরোধীদের প্রশ্ন, প্রস্তাবিত জামিন বিলের ব্যাখ্যার আড়ালে কি আসলে থেকে গেল মদন-সওয়ালই?