তৎকালীন বোম্বাই বন্দর থেকে ব্রিটিশ রাজের চিঠি নিয়ে রাজধানী কলকাতায় আসত যে ট্রেন, তার নাম ছিল ইম্পিরিয়াল মেল। পরে ইম্পিরিয়াল মেলের নাম বদলে হাওড়া-মুম্বই মেল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দার্জিলিঙের চা এস্টেটগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত ঘনঘন নির্দেশ উত্তরবঙ্গে আসত যে ট্রেনে, তার নাম দার্জিলিং মেলই রয়ে গিয়েছে। গবেষকদের দাবি, যাত্রীদের সঙ্গে চিঠিও পাঠানো হবে বলেই ট্রেনের নামে ‘মেল’ শব্দটি জোড়া হয়। সেই ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছে দার্জিলিং মেল।
এমনই নানা ঐতিহ্য-ইতিহাসের সাক্ষ্য থাকা সুপারফাস্ট ট্রেনটি কোন স্টেশন থেকে ছাড়বে, তা নিয়ে উত্তরবঙ্গের দুই অংশের মধ্যে টানাপোড়ের সুর চড়ছেই। রবিবার রাজনীতির রং ভুলে আলিপুরদুয়ারের যুযুধান নেতারা এক হয়ে দাবি করলেন, দার্জিলিং মেল চলুক আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশন থেকে। অন্য দিকে, দার্জিলিং মেলকে নিউ জলপাইগুড়ি থেকেই চালানোর দাবি জোরালো করতে নাগরিক কনভেনশন ডাকার প্রস্তুতি শুরু করল শিলিগুড়ির সংগঠনগুলোও।
এ দিন সকালে আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশনে বিক্ষোভ দেখায় জয়েন্ট ফোরাম। ব্যবসায়ী সংগঠন ও মানবিক মুখ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম, আরএসপি ও কংগ্রেস নেতারা একজোট হয়ে সওয়াল করলেন। আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তী, প্রাক্তন বিধায়ক আরএসপির নির্মল দাস, জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিশ্বরঞ্জন সরকার, সিপিএম নেতা সজল বসু, বিজেপির টাউন ব্লক সভাপতি অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। সকলেই জানান, দার্জিলিং মেলকে আলিপুরদুয়ার থেকে চালুর দাবিতে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এক সঙ্গে পা মেলাবেন। নাগরিক কনভেনশনের অন্যতম উদ্যোক্তা রাতুল বিশ্বাস বলেন, ‘‘সব দলের নেতারা এক টেবিলে বসে বৈঠক করছেন, একমত হচ্ছেন এমন ঘটনাই প্রমাণ করে আলিপুরদুয়ারবাসী দার্জিলিং মেলে কতটা আবেগ দিয়ে পেতে চাইছে।’’
বিজেপির শিলিগুড়ি সাংগঠনিক কমিটির তরফেও এ দিন নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং মেল সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়েছে। এর আগে শিলিগুড়ির সিপিএম, কংগ্রেস এবং তৃণমূল নেতাদের অনেকেই দাবি করেছিলেন এনজেপি থেকেই দার্জিলিং মেল যেমন চলছে তেমনই চলুক। বিজেপির জেলার সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ রায়চৌধুরীর বলেন, ‘‘দার্জিলিং মেলকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করব। বিষয়টি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও জানানো হয়েছে।’’ বৃহত্তর শিলিগুড়ি নাগরিক মঞ্চর সম্পাদক রতন বণিক বলেন, ‘‘কোনও ভাবেই ঐতিহ্যের সাক্ষী দার্জিলিং মেলকে ছাড়া হবে না।’’
রেলের তরফে এ দিনও জানানো হয়েছে, দার্জিলিং মেল নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। শুধু পরিকল্পনাগুলি ভেবে দেখা হচ্ছে। এই পরিকল্পনার মধ্যে এনজেপির পরিবর্তে শিলিগুড়ি জংশন থেকেও দার্জিলিং মেল চালানোর প্রস্তাবও রয়েছে। রেলের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘এনজেপি, শিলিগুড়ি জংশন, আলিপুরদুয়ার সব নিয়েই ভাবে হচ্ছে।’’
১৮৭৯ সালের ১ জানুয়ারি যাত্রা শুরু
• গোড়ায় শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে ক্যালকাটা স্টেশন।
• ক্যালকাটা স্টেশনের নাম বদলে হয় শিয়ালদহ।
• ট্রেন কলকাতা থেকে দার্জিলিং যাওয়ার যোগসূত্র। তাই ‘দার্জিলিং মেল’।
• গঙ্গার উপর দিয়ে সে সময় কোনও রেলসেতু ছিল না। কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে দার্জিলিং মেল পৌঁছত দোমুখদিয়া ঘাটে। দোমুখদিয়া স্টেশনে যাত্রীদের নেমে উঠতে হতো নৌকায়। পদ্মার অন্যপার সরাঘাটে অপেক্ষা করে থাকত দার্জিলিং মেলের আরেকটি রেক। সেটি চলত ন্যারোগেজ লাইনে। তাতে শিলিগুড়ি। ১৯১২ সালে পদ্মার ওপর তৈরি হল হার্ডিঞ্জ রেলসেতু। দেশভাগের পর হার্ডিঞ্জ সেতুর অংশটি ও পার বাংলায় চলে যায়। ফের নৌকায় গঙ্গা পারপার চলে। ফরাক্কা সেতু তৈরির পর কলকাতা-ফরাক্কা-শিলিগুড়ি পর্যন্ত দার্জিলিং মেল চলত। পরে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন (এনজেপি) তৈরি হওয়ার পরে শিলিগুড়ি স্টেশনের পরিবর্তে ট্রেন এনজেপি থেকেই যাতায়াত শুরু করে।
দার্জিলিং মেল এবং ইলিশ মাছ
• পদ্মায় নৌকা পার হয়ে যখন দার্জিলিঙে মেলে যাতায়াত করতে হতো, তখন নাকি যাত্রীদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ইলিশ মাছ। পদ্মার এ পারে বেশ কয়েকটি হোটেল ছিল। পদ্মা নদী থেকে ইলিশ মাছ ধরে ভাজা, সর্ষে, ঝোল যেমন চাওয়া তেমনই নাকি রান্না করে দেওয়া হতো। হার্ডিঞ্জ সেতু তৈরির পর নৌকায় যাতায়াতের প্রয়োজন আর থাকল না। দেশভাগের পর আবার ট্রেন যাতায়াতের সময় ফেরি সার্ভিস তথা নৌকায় গঙ্গা পার হতে হতো। সে সময়ে মণিহারি ঘাটেও মিলত গঙ্গার থেকে ধরা টাটকা ইলিশ মাছের ঝোল।
• দার্জিলিং মেলের বিখ্যাত যাত্রীরা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভগিনী নিবেদিতা, বিপ্লবী যতীন দাস, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, রাজেন্দ্র প্রসাদ, পদ্মজা নাইডু, আসরাবুদ্দিন প্রমুখরা
• বর্তমান যাত্রাপথ
শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি। ৫৬৭ কিলোমিটার।
•দার্জিলিং মেলের কয়েকটি কামরা হলদিবাড়ি পর্যন্ত যায়, সেখান থেকে ছাড়ে। রেলের পরিভাষায় একে স্লিপ রুট বলে। দেশভাগের আগে হলদিবাড়ি দিয়েই ট্রেন শিলিগুড়ি আসত। সেই ঐতিহ্য রক্ষা করতেই স্লিপ রুট চালু রয়েছে।