৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের এই জায়গাতেই বৃহস্পতিবার রাতে গুলিবিদ্ধ হন নবকুমার হাইত। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।
জিপের হেডলাইটের আলোয় দু’জনকে সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল পুলিশের। গাড়ি থেকে নেমে তাদের জেরা শুরু করেছিলেন মহিষাদল থানার কনস্টেবল নবকুমার হাইত। এক যুবকের ব্যাগ তল্লাশি করতে চেয়েছিলেন। রাজি হয়নি সে। নবকুমারবাবু ব্যাগ ধরে টানতেই সেই ব্যাগ খুলে চকিতে রিভলভার বের করে ওই যুবক। ৪৩ বছরের কনস্টেবলের বাঁ কানের নীচে ঢুকে যায় তপ্ত বুলেট!
বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় মহিষাদল থানার কাপাসএড়্যা সেতুর উপর এই ঘটনার পরে আর প্রাণে বাঁচানো যায়নি নবকুমারবাবুকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তাঁর। তার আগেই অবশ্য চম্পট দিয়েছে দুই দুষ্কৃতী।
গার্ডেনরিচে তাপস চৌধুরী, দুবরাজপুরে অমিত চক্রবর্তী, মিরিকে অমোদ গুরুঙ্গ, কোচবিহারে রঞ্জিত পাল— নামগুলোর সঙ্গে এ বার জুড়ে গেলেন নবকুমারবাবুও। ওঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন পুলিশ। আর প্রত্যেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় কর্তব্যরত অবস্থায় খুন হয়েছেন দুষ্কৃতীর হাতে। পুরভোটের দিন খাস কলকাতায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এক অফিসার। তা ছাড়া আলিপুর থেকে বোলপুর— থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর নজিরও কম নেই। অধিকাংশ ঘটনাতেই শাসক দলের দিকে আঙুল উঠেছে। এবং মহিষাদলের ঘটনার পরেও ফের প্রশ্ন উঠেছে, যে রাজ্যে পুলিশই নিরাপদ নয়, সেখানে আমজনতার সুরক্ষা কোথায়?
কী ঘটেছিল মহিষাদলে?
বৃহস্পতিবার রাতে ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কে টহলদার গাড়িটিতে ছিলেন এক এসআই ও তিন কনস্টেবল। প্রথমে কাপাসএড়্যা সেতু পেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল গাড়িটি। ওই দুই যুবককে দেখে তখন সন্দেহ হয়নি পুলিশের। ফিরতি পথেও তাদের একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সহকর্মী কনস্টেবল দুর্যোধন মান্নাকে নিয়ে নেমে পড়েন নবকুমারবাবু। দুই যুবকের কাছেই ছিল ব্যাগ। এক জনের ব্যাক-প্যাক বুকের সামনে ঝোলানো ছিল। সেই ব্যাগটিই দেখতে চাইছিলেন নবকুমারবাবু। তখনই হঠাৎ গুলি!
আততায়ীকে জাপটে ধরতে গিয়েছিলেন দুর্যোধনবাবু। সেই সময়েই বোমা ছোড়ে অন্য জন। দুই দুষ্কৃতী দু’দিকে পালায়। বোমায় কেউ জখম হননি। তবে বোমা ভর্তি ব্যাগ, জ্যাকেট ও হাওয়াই চটি ফেলে যায় তারা। ওই ব্যাগে পাওয়া একটি চিরকুটে লেখা ছিল দু’টি ফোন নম্বর। সেগুলির সূত্র ধরে কাঁথির কুখ্যাত দুষ্কৃতী কর্ণ বেরার নাম পেয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া ছাড়াও ঘটনাস্থলে যান মহিষাদলের সিআই শুভঙ্কর দে, হলদিয়ার এসডিপিও তন্ময় মুখোপাধ্যায়, হলদিয়ার এএসপি কাজী সামসুদ্দিন আহমেদ। এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি।
তবে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও কিছু প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, দুষ্কৃতীরা সংখ্যায় ছিল মাত্র দু’জন। তাদের সঙ্গে গাড়িও ছিল না। তা হলে কেন গাড়িতে থাকা সশস্ত্র পুলিশ তাদের ধরতে পারল না? গুলির শব্দ শুনেও পুলিশ কেন পাল্টা গুলি চালাল না? এসপি-র বক্তব্য, ‘‘এত অল্প সময়ে ঘটনাটি ঘটে যায় যে বাকিরা কিছু করে উঠতে পারেননি।’’ পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, গাড়িতে থাকা মহিষাদল থানার এসআই প্রশান্ত বণিকের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। তাই তিনি রাস্তায় নামার ঝুঁকি নেননি। প্রশান্তবাবু এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে পুলিশকর্মীদের অনেকেই বলছেন, থ্রি-নট-থ্রি বন্দুক চালাতেই অনেকটা সময় বেরিয়ে যায়। তা হলে দুষ্কৃতী-মোকাবিলা হবে কী করে! নবকুমারবাবুর দাদা শুকদেব হাইতও বলেন, ‘‘আদ্যিকালের বন্দুক দিয়ে দুষ্কৃতীদের মোকাবিলা করা অসম্ভব। মুখ্যমন্ত্রীকে বলব, এই কারণেই ভাইয়ের প্রাণ গেল।’’
ঘটনা জেনে হতবাক মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রও। এক সময়ে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বে ছিলেন নবকুমারবাবু। মন্ত্রীর কথায়, ‘‘ছেলেটা খুব ভাল। ওর যে এই পরিণতি হবে ভাবতে পারিনি।’’