মায়ের মন পেতে রোজ সকালে প্রণামের বিধান দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। সেই আদালতই এ বার বলল, সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও ছেলে যদি বৃদ্ধ বাবাকে না-দেখে, তাঁর চিকিৎসা না-করায়, তাকে সোজা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বাধা নেই। বিশেষ করে যে-ছেলে বাবাকে হত্যার হুমকি দেয়, তাকে কোনও মতেই বাড়িতে ঠাঁই দেওয়া যায় না।
ভরণপোষণের ভার না-নিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের উপরে পীড়ন এবং বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার বিভিন্ন ঘটনায় অভিযুক্ত ছেলে-মেয়ে-বৌমার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। কিন্তু পরিস্থিতির বিশেষ বদল যে হয়নি, একই ধরনের নিত্যনতুন মামলাই তার প্রমাণ। বৃহস্পতিবার জগদ্দল থানা এলাকার এই ধরনের একটি মামলায় হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ, স্বনির্ভর, সমর্থ কোনও ছেলে যদি সত্তোরোর্ধ্ব বাবার চিকিৎসা না-করায়, তা হলে বাবার বাড়িতে তার থাকার অধিকার থাকতে পারে না। বাবা চাইলে ছেলেকে বাড়ি থেকে বার করে দিতেই পারেন। ছেলে অন্যত্র বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পারে।
এই পর্যবেক্ষণের পরে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত এ দিন ছেলেকে নির্দেশে দিয়েছেন, বাবার হৃদ্যন্ত্রের চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, কোন হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, ১৩ জুন অর্থাৎ সোমবারের মধ্যে আদালতে হলফনামা দিয়ে তা জানাতে হবে।
জগদ্দল থানা এলাকার শ্যামনগর গুড়দহ-শালবাগানের বাসিন্দা বিমলচন্দ্র পাল রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্মী ছিলেন। তাঁর আইনজীবী সন্তোষকুমার চক্রবর্তী ও স্বপনকুমার মিত্র জানান, ২০০৩ সালে বিমলবাবু অবসর নেন। পেনশন পান সামান্য টাকা। গুড়দহে তাঁর তিন কাঠা ১৪ ছটাক জমি ছিল। তার মধ্যে দু’কাঠা চার ছটাক জমিতে তিনি একতলা বাড়ি তুলেছেন। বাকি জমি খালি পড়ে আছে। অবসরকালীন পাওনার বেশির ভাগ টাকা খরচ করে তিনি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাড়িতে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী, ছেলে বিকাশ ও পুত্রবধূ। বিকাশ মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেন।
আবেদনকারীর আইনজীবীরা জানান, তাঁদের মক্কেল বিমলবাবু সম্প্রতি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নিজেই এসএসকেএম হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকে দিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। চিকিৎসক তাঁকে জানান, খুব দ্রুত তাঁর হৃৎপিণ্ডের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। অস্ত্রোপচারের খরচ দু’লক্ষ টাকা। সেই টাকা সংগ্রহের জন্য বাড়ির লাগোয়া এক কাঠা ১০ ছটাক জমি বিক্রি করতে চান ওই বৃদ্ধ। ক্রেতাও পেয়ে যান।
কিন্তু বিমলবাবুর ছেলে বিকাশ এবং বিকাশের শ্বশুর, ঝাউতলা উকিলবাগানের বাসিন্দা প্রদীপ দে বাদ সাধেন বলে অভিযোগ। বাবা জমি বিক্রি করতে চাইছেন জেনে ছেলে তাঁর উপরে মানসিক অত্যাচার শুরু করেন। তাতে ইন্ধন জোগান ছেলের শ্বশুর। হুমকি দেওয়া হয়, জমি বিক্রি করলে বিমলবাবুকে মেরে ফেলা হবে। হুমকির পরেই গত ১৯ অক্টোবর জগদ্দল থানায় ছেলে এবং ছেলের শ্বশুরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ (জেনারেল ডায়েরি নম্বর: ১২২৭) করেন বৃদ্ধ বিমলবাবু।
আদালতে বৃদ্ধের অভিযোগ, জেনারেল ডায়েরি করার পরেও পুলিশ হত্যা-হুমকির কোনও তদন্ত করেনি। ছেলে ও ছেলের শ্বশুরের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি তারা। এমনকী নিজের চিকিৎসার জন্য তিনি যাতে জমি বেচতে পারেন, সেই ব্যাপারে তাঁকে কোনও সাহায্যও করেনি।
১৮ এপ্রিল এই মামলার শুনানিতে সরকারি কৌঁসুলি শুভব্রত দত্ত আদালতে জানান, ছেলে যাতে ইএসআই হাসপাতালে বাবার চিকিৎসা করান, সেই ব্যবস্থা করতে সাহায্য করবে পুলিশ। বিকাশের আইনজীবী অনিন্দ্য বসু জানান, ইএসআই হাসপাতালে ভর্তি করানোর সুযোগ থাকলে বাবার চিকিৎসার জন্য কী কী করা হবে, তাঁর মক্কেল মুচলেকা দিয়ে তা জানাবেন। কিন্তু তার পরেও চিকিৎসার কোনও বন্দোবস্ত হয়নি।
এ দিন আবার সেই মামলার শুনানি ছিল। বিমলবাবুর কৌঁসুলিরা জানান, তাঁদের মক্কেলের ছেলে ইএসআই হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পান না। এ দিকে বিমলবাবুর হৃদ্যন্ত্রের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। চিকিৎসকেরা তাড়াতাড়ি অস্ত্রোপচার করিয়ে নিতে বলেছেন। যথাযথ চিকিৎসার জন্য বৃদ্ধ যে জমি বেচে টাকা জোগাড় করবেন, সেই পথেও কাঁটা। কারণ, ছেলে এবং ছেলের শ্বশুর তাতে বাধা দিচ্ছেন। হুমকি দিচ্ছেন। বিমলবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর বাড়ি ছেলেকেই দিয়ে যেতে চান। ওই জমি বেচতে ছেলে যাতে বাধা না-দেন, সেই অনুরোধও করা হয়েছে। কিন্তু ফল হয়নি।
এই সওয়াল শুনেই বিচারপতি দত্ত জানান, বেয়াড়া ছেলেকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া যেতেই পারে। তার পরে বিকাশের আইনজীবীকে বিচারপতি নির্দেশ দেন, চার দিনের মধ্যে হলফনামা দিয়ে জানানো হোক, বাবার অস্ত্রোপচারের জন্য ছেলে কোন হাসপাতালে কী বন্দোবস্ত করেছেন। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে যে-অভিযোগ উঠেছে, সেই বিষয়ে হাইকোর্ট অবশ্য এ দিন কোনও নির্দেশ দেয়নি।