আলু-জট কাটাতে আমলা বাদ দিয়ে কমিটি চায় কোর্ট

আলুচাষিদের সঙ্কট কাটাতে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে যে-সব ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে আলু ব্যবসায়ী ও পরিবহণ ব্যবসায়ীদেরই লাভ হয়েছে বলে মনে করে কলকাতা হাইকোর্ট। এই অবস্থায় ডিভিশন বেঞ্চ মঙ্গলবার সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে, সমস্যার সমাধানে একটি বিশেষ কমিটি গড়া হোক। তবে সেই কমিটিতে যেন কোনও আমলার ঠাঁই না-হয়। আদালত চায়, ওই কমিটি গড়া হোক কৃষি-বিশেষজ্ঞ, বাজার-বিশেষজ্ঞ, কৃষকদের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের নিয়েই। উৎপাদন কম হোক বা বেশি, আলু নিয়ে সমস্যায় পড়াটাই যেন এ রাজ্যের দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে! গত বছর চলছিল আলুর টানাটানি। ফলে দাম প্রায় আকাশ ছোঁয়। লেজেগোবরে হতে হয় সরকারকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৪
Share:

আলুচাষিদের সঙ্কট কাটাতে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে যে-সব ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে আলু ব্যবসায়ী ও পরিবহণ ব্যবসায়ীদেরই লাভ হয়েছে বলে মনে করে কলকাতা হাইকোর্ট। এই অবস্থায় ডিভিশন বেঞ্চ মঙ্গলবার সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে, সমস্যার সমাধানে একটি বিশেষ কমিটি গড়া হোক। তবে সেই কমিটিতে যেন কোনও আমলার ঠাঁই না-হয়। আদালত চায়, ওই কমিটি গড়া হোক কৃষি-বিশেষজ্ঞ, বাজার-বিশেষজ্ঞ, কৃষকদের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের নিয়েই।

Advertisement

উৎপাদন কম হোক বা বেশি, আলু নিয়ে সমস্যায় পড়াটাই যেন এ রাজ্যের দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে! গত বছর চলছিল আলুর টানাটানি। ফলে দাম প্রায় আকাশ ছোঁয়। লেজেগোবরে হতে হয় সরকারকে। এ বার সরকারকে সমস্যায় ফেলেছে আলুর পর্যাপ্ত উৎপাদন। দাম না-পেয়ে চাষিরা অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করছেন। এ দিন আলুচাষিদের সঙ্কট নিয়ে জনস্বার্থের মামলার শুনানি ছিল হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে। রাজ্যের অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেল লক্ষ্মী গুপ্ত আদালতে জানান, চলতি বছরে রাজ্যে এক কোটি মেট্রিক টন আলু উৎপন্ন হয়েছে। রাজ্যের হিমঘরগুলির ৯৮ শতাংশ ভর্তি হয়ে গিয়েছে আলুর বস্তায়। সরকারের পক্ষে নতুন হিমঘর তৈরি করা সম্ভব নয়। আলুচাষিদের সঙ্কটে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেই ব্যাপারে ইতিমধ্যেই ডিভিশন বেঞ্চে হলফনামা পেশ করা হয়েছে।

লক্ষ্মীবাবুর বক্তব্য শুনে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, সরকারের গৃহীত ব্যবস্থায় উপকৃত হয়েছেন শুধু আলু ব্যবসায়ী আর পরিবহণ ব্যবসায়ীরাই। তার পরেই মুশকিল আসানে আদালতের ভাবনাচিন্তার কথা তোলেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, “আলুচাষিদের সঙ্কট নতুন নয়। কী করে সমস্যার সমাধান হবে, রাজ্য সরকার তো আগেই সেই বিষয়ে ভাবতে পারত। আমি আগেই বলেছি, সরকারের উচিত কৃষকদের নিয়ে সমবায় তৈরি করা। রাজ্য সরকার কৃষক মান্ডিও গড়তে পারে।” দক্ষিণ ভারতে কৃষক মান্ডি সাফল্য পেয়েছে বলে জানান প্রধান বিচারপতি।

Advertisement

সমবায়, কৃষক মান্ডির সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ কমিটি তৈরির প্রস্তাব দিয়েই থেমে যায়নি হাইকোর্ট। কী ভাবে তৃণমূল স্তরে গিয়ে কৃষকদের সমস্যার সমাধান করা যায়, সেই বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেলের সঙ্গে আদালতেই এক প্রস্ত আলোচনা করে নেয় ডিভিশন বেঞ্চ। লক্ষ্মীবাবু জানান, সমবায় ও কৃষক মান্ডির বিষয়ে তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। প্রধান বিচারপতি প্রস্তাব দেন, সরকার আলু বিক্রির ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে বা অন্যত্র বিজ্ঞাপন দিতে পারে। তা দেখে ভিন্ রাজ্যের ক্রেতারা এখানে এসে আলু কিনতে পারেন। ডিভিশন বেঞ্চের অন্য বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেলকে বলেন, “আমরা রাজ্য সরকারকে ক্রেতা হতে বলছি না। তবে কৃষকদের স্বার্থ তারা অন্য ভাবে রক্ষা করতে পারে।” আলুচাষিদের সঙ্কট কাটাতে রাজ্যের পরিকাঠামোরও উন্নতি করা দরকার বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি।

বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “আলুচাষিদের আত্মহত্যা নিয়ে রাজ্যের অনেক নেতা-মন্ত্রীই তো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন। আদালত বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখছে বলে কৃষকেরা কৃতজ্ঞ। এ বার যদি সরকারের টনক নড়ে!”

সমস্যা মেটাতে তিনিও কিছু প্রস্তাব নিয়ে দিতে পারেন বলে হাইকোর্টে জানান জনস্বার্থ মামলার আবেদনকারীর কৌঁসুলি বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, সরকারের সঙ্গে তিনি কোনও রকম বিবাদে যেতে চান। যে-কোনও মূল্যে চাষিদের স্বার্থ রক্ষা করাই তাঁর উদ্দেশ্য। বিকাশবাবুর অভিযোগ, সরকার আলু কেনায় ভর্তুকি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেই ভর্তুকি তৃণমূল স্তরের কৃষকদের কাছে পৌঁছচ্ছে না।

আলু কেনার ব্যাপারে আদালত বিজ্ঞাপন এবং অন্য যে-সব প্রস্তাব দিয়েছে, সেই বিষয়ে কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় জানান, বিচারপতিদের বক্তব্যের প্রতিলিপি না-পেলে তাঁরা কোনও মন্তব্য করবেন না। ওই প্রতিলিপি এলে আলাপ-আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মেনে আমরা জেলাশাসকদের বলেছি, সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে আলু কিনতে হবে। সে-ভাবেই কাজ করা হচ্ছে।”

সিপিএম নেতা আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের বাম বিধায়কদল এ দিনই বর্ধমানের আত্মঘাতী আলুচাষিদের বাড়িতে যায়। প্রথমে ওই প্রতিনিধিরা যান ভাতারের ছাতিমডাঙা গ্রামে মৃত চাষি গুড্ডু মুর্মুর বাড়িতে। গুড্ডুর কত বিঘা জমিতে আলু চাষ করা হয়েছিল, কত দেনা ছিল, কিসান ক্রেডিট কার্ড আছে কি না, সমবায় থেকে ঋণ নিয়েছিলেন কি না সবই খুঁটিয়ে জানতে চান তাঁরা। শ্যাম টুডু, অনিল সরেনের মতো স্থানীয় চাষিরা অভিযোগ করেন, “শুধু আলু কেন, এখানে কোনও ফসলই কেনে না সরকার। অভাবে পড়ে জলের দরে ফসল বেচে দিতে হয়। আমরা সমবায় থেকে কোনও ঋণ পাই না। সার, কীটনাশকও কিনতে হয় চড়া দামে।”

পরে আনিসুর অভিযোগ করেন, উদ্বৃত্ত আলুর কী হবে, সরকার তার দিশা দেখাতে পারেনি। কয়েক বছরে যথেষ্ট হিমঘরও তৈরি হয়নি। ফড়েরা আলুর দখল নিয়েছে। হিমঘরগুলিও ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গিয়েছে। তিনি বলেন, “পুলিশ-প্রশাসন শুধু বলছে, এই চাষিরা মদ খেয়ে, পারিবারিক অশান্তিতে বিষ খেয়েছে। কিন্তু আলুচাষিরা বিষ খাচ্ছে কেন, সরকার তার তদন্ত করছে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন