মনিরুল-কাণ্ডে শাসক দলের উপরে রাজনৈতিক চাপ বাড়ানোর কৌশল নিল বামেরা।
লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আরও একটি খুনের ঘটনার অভিযোগ মঙ্গলবার সামনে আনল বিরোধী বামেরা। বীরভূম জেলা সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, লাভপুরে তিন সিপিএম সমর্থক ভাই খুনের মাসখানেক আগে একই এলাকায় সিপিএমের এক জোনাল সদস্য-সহ তিন জনকে বোমা মেরে খুন করা হয়েছিল। তাঁদের অভিযোগ, ওই ঘটনাতেও মনিরুল মূল অভিযুক্ত। কিন্তু আগের মতো এই মামলাতেও পুলিশ গত চার বছরেও চার্জশিট জমা না দেওয়ায় বিচার মেলেনি।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে একটি বাম প্রতিনিধিদল এ দিনই লাভপুরে জরিনা বিবিদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে জেলা সিপিএম আগের ঘটনায় নিহত এক দলীয় কর্মীর মা ও মেয়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেয়। জরিনাদের অভিজ্ঞতা দেখে গ্রামছাড়া ওই পরিবারেরও আশঙ্কা, এই মামলাতেও পুলিশ চাজর্শিট থেকে অভিযুক্ত বিধায়কের নাম বাদ দিয়ে দেবে। সূর্যবাবু অবশ্য জরিনা-সহ স্বজনহারা সব পরিবারের লড়াইয়েরই পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “বিচার পাওয়ার জন্য যেখানে যাওয়ার, যাব। যা করণীয় আছে, করব। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে রাজ্য প্রশাসন কেমন কাজ করছে, সবাই দেখতেই পাচ্ছেন! তবে মানুষের আদালতে এক দিন ঠিকই বিচার হবে এ সবের!” এর পরেই তীব্র কটাক্ষে ( গত ১০ জুলাই বোলপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার প্রসঙ্গে) সূর্যবাবু বলেছেন, “অভিযুক্ত বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে বসে আছেন! আর মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব পেয়াদার মতো দাঁড়িয়ে আছেন!”
২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি রাতে লাভপুরে লাঙলহাটা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দলের এক জোনাল সদস্য-সহ তিন জনকে খুন করা হয়েছিল। নিহতদের পরিবারের দাবি, ঘটনায় দলের তৎকালীন জেলা সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম-সহ তৃণমূলেরই ২১ জন কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ লাঙলহাটা বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে বসেছিলেন স্থানীয় কাজিপাড়ার সিপিএম কর্মী ঠান্ডু শেখ (৩৬) ও লাঙলহাটারই বাসিন্দা জামালউদ্দিন শেখ (৪৩)। দুষ্কৃতীদের বোমার ঘায়ে ঘটনাস্থলেই দু’জনের মৃত্যু হয়। এর পরেই সিপিএম নেতা ফজলুল করিমকে (৫১) বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কাছেই বোমা মেরে খুন করা হয়।
জরিনাদের ঘটনা নিয়ে আদালতও যখন রাজ্য সরকারের অবস্থান জানতে চাইছে, সেই সময়ে ওই তিন জনের খুনের ঘটনা সামনে এনে রাজ্য প্রশাসন ও শাসক দলের উপরে আরও চাপ বাড়াতে চাইছেন সিপিএম নেতৃত্ব। দলের লাভপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক পল্টু কোঁড়ার দাবি, “ওই মামলাতেও পিতৃহীন কিশোরী রেকশোনা খাতুনেরা আজও বিচার পায়নি। পুলিশ-প্রশাসনের মদতে শাসক দল সে সব মামলা ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমরা সংবাদমাধ্যমের কাছে ওই তথ্য তুলে ধরে অপরাধীদের মুখোশ খুলে দিতে চাই।” বোলপুরের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোমের অভিযোগ, “ওই হত্যাকাণ্ডে মনিরুলের নামে অভিযোগ হলেও শাসক দলের পুলিশ তা ধামাচাপা দিতে চাইছে।”
ওই হত্যাকাণ্ডে থানায় লিখিত অভিযোগকারিণী, নিহত ফজলুলের স্ত্রী আরজিয়া করিম অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। বারবার ফোন করে এবং এসএমএস পাঠিয়েও প্রতিক্রিয়া মেলেনি বিধায়ক মনিরুলেরও। জেলার বর্তমান পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার বক্তব্য, “ওই মামলা সম্পর্কে কিছু জানি না। বিশদে না জেনে মন্তব্য করব না।”
এ দিন বিরোধী দলনেতা তাঁদের বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই জরিনা সূর্যবাবুর দু’হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “তিন ছেলেকে হারিয়েছি। অভিযুক্তেরা সবাই এখনও ধরা পড়েনি। অথচ তারাই এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! দয়া করে আপনি কিছু করুন!” জরিনা অভিযোগ করেন, মনিরুলের সঙ্গীরা মামলা থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য তাঁদের হুমকি দিচ্ছে। অভিযোগ জানালেও পুলিশ তাদের ধরছে না। সূর্যবাবু আশ্বাস দেন, “চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলেদের খুনের বিচার না মেলা অবধি আমরা সঙ্গে থাকব।” একই সঙ্গে তাঁর খেদোক্তি, “কাকে বলব! স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই তো এ সবের মদতদাতা!”
বিরোধী দলনেতাকে কাছে পেয়ে জরিনার মতো একই আবেদন জানিয়েছে নিহত সিপিএম কর্মী ঠান্ডু শেখের মেয়ে রেকশোনা। মা উজ্জ্বলা বিবির সঙ্গে এসেছিল একাদশ শ্রেণির ওই ছাত্রী। বাবার খুনের পরে বিড়ি বেঁধে আর দাদার দিনমজুরির আয়ে সংসার চলে। জরিনাদের মতো তারাও গ্রামছাড়া। সেই থেকে লাভপুরেরই অন্য একটি গ্রামে মা ও দাদার সঙ্গে থাকে। রেকশোনার অভিযোগ, “বাবাকে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য মনিরুলের লোকেরা চাপ দিত। বাবা শোনেনি। সেই অপরাধেই মনিরুলের নেতৃত্বে বাবাকে খুন করা হয়। মরার আগে বাবা পুলিশের কাছে সেই মর্মে বয়ানও দিয়েছিল। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।”
উজ্জ্বলা বিবি জানান, শাসক দলের বিধায়কের নাম থাকায় তাঁরা সুবিচারের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে জরিনাদের বিষয়টি জেনে সামান্য আশার আলো দেখছেন। নিহত কর্মীর স্ত্রী-মেয়ের কাছে সব কথা শুনে সূর্যবাবু তাঁদের বলেন, “আপনাদের এই মামলা সম্পর্কে আমি পুলিশের কাছে খোঁজ নেব। পুলিশ কোনও তথ্য দিতে না চাইলে, আদালতেরও শরণাপন্ন হব।” এলাকায় আরও কেউ এই রকম ঘটনার শিকার হয়েছেন কি না, তা জানাতেও স্থানীয় নেতৃত্বকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।