জোট বলতে যা বোঝায়, তা এ বার হয়নি, আক্ষেপ ময়না-তদন্তে

জোট জরুরি ছিল। পরিস্থিতির চাপে নিচু তলার চাহিদায় সাড়া দিয়েছিলেন দু’দলের নেতৃত্বই। তবু তার মধ্যেই থেকে গিয়েছিল ফাঁকফোকর। সেই ছিদ্রপথেই শেষ পর্যন্ত ভরাডুবির বানের জল ঢুকে গিয়েছে বলে এখন উঠে আসছে ময়না তদন্তে!

Advertisement

সঞ্জয় সিংহ ও দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০৩:৪৮
Share:

জোট জরুরি ছিল। পরিস্থিতির চাপে নিচু তলার চাহিদায় সাড়া দিয়েছিলেন দু’দলের নেতৃত্বই। তবু তার মধ্যেই থেকে গিয়েছিল ফাঁকফোকর। সেই ছিদ্রপথেই শেষ পর্যন্ত ভরাডুবির বানের জল ঢুকে গিয়েছে বলে এখন উঠে আসছে ময়না তদন্তে!

Advertisement

কংগ্রেস এবং বাম, দুই শিবিরের নেতারাই স্বীকার করছেন, আক্ষরিক অর্থে জোট বলতে যা বোঝায়, তা এ বার হয়নি। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘জোট নয়, বিরোধী ভোট ভাগাভাগি আটকানোর জন্য আসন সমঝোতা হয়েছিল।’’ কিন্তু সমঝোতার রসায়নেও যে ঘাটতি ছিল, সর্বত্র একই রকম আন্তরিকতা দেখা যায়নি, এখন ঠেকে শিখছেন নেতারা! শিলিগুড়িতে সিপিএমের অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকারেরা কংগ্রেসের শঙ্কর মালাকারদের নিয়ে শাসকের সন্ত্রাস রুখে দিয়ে পুরসভা দখল করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিধানসভা ভোটে সেই ‘শিলিগুড়ি মডেলে’র ছবি কংগ্রেস-বাম জোট তুলে ধরতে পারেনি। দু’বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেসের সম্মিলিত ভোটের চেয়ে এ বার জোটের ভোটও বাড়েনি।

কংগ্রেস শিবিরের একাংশের বক্তব্য, প্রথম দিকে অধীর চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সি, মানস ভুঁইয়ার মতো নেতাদের অনেকেই ‘একলা চলা’র পক্ষে ছিলেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে এবং চোখের সামনে ‘শিলিগুড়ি মডেল’ থাকায় আব্দুল মান্নান, সোমেন মিত্রের মতো প্রবীণ নেতারা আসন সমঝোতা করে লড়াইয়ের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত হাইকম্যান্ডের নির্দেশে বামের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়তে নেমেছিল কংগ্রেস। কিন্তু শাসক তৃণমূল যখন হৈ হৈ করে ভোটের ময়দানে নেমে পড়েছে, বিরোধীদের বোঝাপড়ার প্রক্রিয়াগত দিক ঠিক করতেই তখন অনেক সময় চলে গিয়েছে! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, ‘‘ভোট যখন শিয়রে, সেই সময়ে বামেদের সঙ্গে আসন সমঝোতা বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।’’

Advertisement

দুই শিবিরের মধ্যেই মত উঠে আসছে, মান্নান-বিকাশ ভট্টাচার্যদের নিয়ে অন্তত দু’বছর আগে যখন ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল, সেই সময় থেকেই বাম ও কংগ্রেস একসঙ্গে নানা বিষয়ে পথে নামতে শুরু করলে ভোটের বাজারে এসে আর টানাপড়েন দরকার হতো না। উদাহরণ দিয়ে মান্নান বলছেন, বীরভূমের নানুরে শাসকের ‘সন্ত্রাস ও অত্যাচারে’র প্রতিবাদে ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’ এবং সিপিএম যৌথ ভাবে দু’বছর ধরে আন্দোলন করেছে। মান্নানের দাবি, ওই আন্দোলনের তৈরি করা জমিতে দাঁড়িয়েই নানুরে এ বার জোট-প্রার্থী তৃণমূলকে হারাতে পেরেছেন।

জোট নিয়ে আড়ষ্টতা ছিল বাম শিবিরেও। সিপিএমের মধ্যে প্রকাশ কারাট শিবির আদর্শগত প্রশ্ন তুলে জোটের পক্ষে ছিল না। কেরল ও ত্রিপুরার সিপিএম থেকেও আপত্তি ছিল। আবার কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা নিয়ে এ রাজ্যে বামফ্রন্টের শরিক আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতারা খুব প্রসন্ন ছিলেন না। নিজেদের ঘরের বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখেই সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বা দলের কোনও পলিটব্যুরো সদস্য সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর মতো কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করতে চাননি। এমনও হয়েছে, সিঙ্গুরে অধীর এবং ইয়েচুরি একই সভায় প্রচারে গেলেও একই সময়ে দু’জনে মঞ্চে থাকেননি! দু’তরফের যৌথ কোনও বিবৃতি হয়নি। সরকারে এলে যৌথ কর্মসূচি কী হবে, তার কোনও ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। এই গা বাঁচিয়ে চলা খুব ইতিবাচক বার্তা দেয়নি জনমানসে। সেই সঙ্গেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য মানছেন, ‘‘মানুষের মনে এই প্রশ্নও ছিল, জোট সরকার এলে তার মাথা কে? আমরা বামপন্থী দলে আগে থেকে কাউকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করি না বলে জানিয়েছি ঠিকই। কিন্তু মানুষের কাছে তার জন্য জোট ঘিরে অনিশ্চয়তা থেকে গিয়েছে।’’

প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সিপিএমের তরফে তা-ও আন্তরিক চেষ্টা ছিল নিজেদের ভোট কংগ্রেসের বাক্সে স্থানান্তর করার। যে কারণে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র স্বয়ং জেলায় জেলায় সাধারণ সভা করে বলে এসেছিলেন, কংগ্রেসকে নিয়ে খোলা মনে ভাবতে হবে। তৃণমূলকে হারাতে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে ভোটটা কংগ্রেসকেই দিতে হবে। সার্বিক ভাবে এমন উদ্যোগ কিন্তু কংগ্রেসের দিক থেকে ছিল না। তাই বাস্তবে বামেদের ভোট কংগ্রেস পেলেও কংগ্রেসের সব ভোট বামে পড়েছে কি না, তা নিয়ে দুই শিবিরই এখন সংশয় কবুল করে নিচ্ছে। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার মতে, জোটের মধ্যে সমন্বয় এবং আদানপ্রদানে ঘাটতি ছিল। মানসবাবুর দাবি, ‘‘সবংয়ে আমরা খোঁজ পেয়েছি, কট্টর কংগ্রেস বা কট্টর বামেদের অনেকেই ভোট দেননি। ওই ভোট পেলে আমি যা ভোট পেয়েছি, তার চেয়ে ১০-১৫% বেশি ভোট পেতাম। অন্তত ৭০ হাজার ভোটে জিততাম!’’

তবে এ সব কাটাছেঁড়ার পরে প্রশ্ন হল, জোট কি জারি থাকবে? এই প্রশ্নেও কংগ্রেসের অন্দরে এখনই দ্বিমত তৈরি হয়েছে! প্রদেশ সভাপতি অধীর বলছেন, ‘‘আমাদের বামেদের মতো ছুঁৎমার্গ নেই! আন্তরিকতা ও উদারতার সঙ্গে আমরা জোট প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে চাই।’’ জোটের অন্যতম প্রবক্তা মান্নানও মনে করেন, ‘‘শাসকের সন্ত্রাস রুখতে জোটকে জিইয়ে রাখতে হবে। না হলে মানুষ এই ধরনের জোটে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে।’’ বামেদের সঙ্গে তাঁদের জোটকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দিতে একত্রে গণ আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে চান অধীর-মান্নানেরা। কিন্তু শুক্রবারই দিল্লিতে এআইসিসি নেতা পি সি চাকো বোঝাতে চেয়েছেন, ভোট শেষ, সিপিএমের সঙ্গে জোটও শেষ! তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সঙ্গে কোনও সমন্বয় কমিটি গঠন হয়নি। এই জোট স্থায়ী কিছু নয়। শুধুমাত্র আসন সমঝোতা হয়েছিল। ভবিষ্যতে দরকার হলে ফের দেখা যাবে!’’

তা হলে কি ভবিষ্যতে তৃণমূলের সঙ্গেও হাত মেলাতে পারে কংগ্রেস? এই প্রশ্নের জবাবে চাকো বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে কী হবে, কী করে বলতে পারি? আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো কংগ্রেসেই ছিলেন। নিজের দল গড়েছেন, সেটাও তো বেশি দিন হয়নি!’’ বাংলায় জোট আশানুরূপ ফল না করতেই চাকোর এমন মন্তব্য আসলে মমতার সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা হিসাবেই দেখছে দলের একাংশ। একের পর এক রাজ্য হারিয়ে কংগ্রেসের সামনে এ ছাড়া বিশেষ পথ নেই বলে ওই অংশের ধারণা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন