রূপনারায়ণ দাসকে (ইনসেটে) সমাহিত করার আগে শেষ শ্রদ্ধা। বৃহস্পতিবার রাতে করঞ্জি গ্রামে।ছবি: সোহম গুহ।
জুন মাসে ফিরে নতুন বাড়ি তৈরি করবে বলে ঠিক করে রেখেছিলেন দাস বাড়ির বড় ছেলে। ডিসেম্বরে তেমনই কথা হয়েছিল বাবা দুর্যোধন দাসের সঙ্গে। কিন্তু মার্চ মাস শেষ হতেই ফিরে এল ছেলে। আর কোনও দিন বাইরে যাবে না। পুরনো বাড়ির পাশেই ঠাণ্ডা মাটিতে তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে, চিরদিনের মতো।
ছত্তিসগঢ়ের দান্তেওয়াড়াতে বুধবার মাওবাদীদের পেতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন সাত সিআরপিএফ জওয়ান। তাঁদেরই মধ্যে একজন কাঁথির করঞ্জি গ্রামের যুবক রূপনারায়ণ দাস (২৯)। সে রাতেই গ্রামে এসে পৌঁছেছিল ছেলের শহীদ হওয়ার খবর। রূপনারায়ণের বাড়ির সামনে ভিড় জমেছিল হাজার মানুষের। বৃহস্পতিবার রাত ৯টা নাগাদ দেহ নিয়ে এসেছিল সেনা।
রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ আর প্রতিবেশীদের ভি়ড়ে ছোট্ট বাড়ির উঠোন ভেঙে পড়ছিল। কাঁথির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাফর আজমল কিদোয়াই, এসডিপিও ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়-সহ কাঁথি ও জুনপুট কোস্টাল থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী। ভারতীয় সেনার ‘গার্ড অব অনার’-এ পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রূপনারায়ণের শেষকৃত্য হয়। বৈষ্ণব পরিবারের রীতি মেনে বাড়ির পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
কিন্তু এ সব কিছুর মধ্যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে রূপনারায়ণের দেড় বছরের ছেলে সায়ন। মাকে পাগলের মতো কাঁদতে দেখে কখনও কেঁদে ফেলেছে, কখনও আবার ঠাকুমার গলা জড়িয়ে হেসেছে কিছুই না-বুঝে। শুক্রবার সকালেও দাস বাড়ির সামনে গ্রামের মানুষের ভিড়। রূপনারায়ণের সমাধির সামনে বসে একটানা কেঁদেই চলেছে তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা। কাঁদতে কাঁদতে কখনও কখনও তাঁর জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছে। প্রতিবেশীরাই এক সময় জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছে তাঁকে ঘরের ভিতরে। শাশুড়ি সন্ধ্যাদেবীও বাক্যহারা।
প্রতিবেশী রুনা কামিলা, কবিতা জানা, কৃষ্ণা শ্যামলরা জানান, অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে রূপনারায়ণ উচ্চমাধ্যমিকের পর ২০০৭ সালে সিআরপিএফে চাকরি পান। তারপর তাঁদের পরিবারে কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে। ২০১২সালে বিয়ে করেন পাশের গ্রামের কৃষ্ণাকে। গত ডিসেম্বরে শেষবারের জন্য বাড়িতে এসে এসেছিলেন রূপ।
দুর্যোধনবাবু শুক্রবার সকালে জানালেন, “প্রায় দশবছর ধরে আমার ছেলে জওয়ান। গত বছর পুজোর সময় মণিপুর থেকে ছত্তিসগঢ়ে বদলি হল। মাঝে ডিসেম্বরে একমাসের জন্য বাড়ি এসেছিল। জুন মাসে এসে বাকিটা করবে বলে গিয়েছিল। আমার বৌমা আর নাতির কি হবে?” রূপনারায়ণের ছোট ভাই তুফান কেরলে থাকেন।
করঞ্জি গ্রামের বাসিন্দা কাঁথি-১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি রতন জানা বলেন, “রূপ গ্রামের সেরা ছেলে ছিল। হাসিখুশি, সবার সঙ্গেই খোলামেলা ভাবে মিশতো। সকলেই ওকে ভালোবাসতো। এমন একটা ঘটনা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। তবে গোটা করঞ্জি গ্রাম গর্বিত ওর।”
রূপনারায়ণের সহকর্মী অরুণ মাহাত জানান, বুধবার দান্তেওয়াড়েতে সিআরপিএফের মূল অফিস থেকে গাড়িতে করে ইউনিটে ফেরার সময় বিচলি নামে একটি জায়গায় ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরন ঘটে। বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান সাত জওয়ান। সহকর্মীদের মধ্যেও অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন রূপনারায়ণ।