আলিপুর চিড়িয়াখানার সেরা আকর্ষণ এই তিন শিম্পাঞ্জিকেই ফেরাতে বলেছে শুল্ক দফতর। —ফাইল চিত্র।
চিড়িয়াখানার ফটক পেরিয়ে, বাঁ হাতে আড়াআড়ি দু’কদম হাঁটলে যে এনক্লোজারটার সামনে সম্বৎসরের থিকথিকে ভিড়, সেটা শিম্পাঞ্জির।
আলিপুর চিড়ায়াখানার সেরা আকর্ষণ, মস্তান, বাসন্তী আর ছোটু —সেই তিন শিম্পাঞ্জিকেই ‘ফিরিয়ে’ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শুল্ক দফতর। কোথায়?
শুল্ক কর্তার চিঠির (০৬/সিইউএস/সিসি-পি/২০১৬) বয়ান বলছে— আড়াই বছর আগে, বাগুইহাটির যে পশু-ব্যবসায়ীর বাড়িতে হানা দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছিল তিন শিম্পাঞ্জি-শাবককে, ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের জিম্মাতেই। উত্তর শহরতলির সেই পশু ব্যবসায়ীর ঠিকানায় চেষ্টা করেও অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি।
চিড়িয়াখানায় ‘বিনিময় প্রথা’ নতুন নয়। জিরাফ দম্পতির বদলে গন্ডার শাবক, চিতাবাঘের পরিবর্তে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে ক্যাঙারু পরিবার— এমন আদান প্রদান চলছেই। স্থান সঙ্কুলানের জন্য, হস্তী দম্পতিকে উত্তরবঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়ারও নজির রয়েছে। তা বলে, উদ্ধার হওয়ার পরে খোলা এনক্লোজারে বড় হয়ে ওঠা শিম্পাঞ্জিদেরও ফিরিয়ে দিতে হবে?
চিড়িয়াখানার সদস্য সচিব বিনোদ যাদব বলছেন, ‘‘এটা হয় নাকি, অস্বাস্থ্যকর প্রায় অন্ধকূপে বেআইনি ভাবে ওদের আটকে রাখা হয়েছিল বলেই তো আদালতের নির্দেশ ছিল— চিড়িয়াখানার পরিবেশই ওদের জন্য আদর্শ।’’ তাঁর প্রশ্ন, আদালতকে ডিঙিয়ে শুল্ক দফতর এমন নির্দেশ জারি করে কী করে?
বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মনও বিষয়টা শুনে বেজায় চটেছেন। বলছেন, ‘‘এ কি মগের মুলুক, ইচ্ছে হল আর ফরমান জারি করলাম!’’ বিষয়টা মুখ্যমন্ত্রীর কানেও তুলেছেন তিনি।
শুল্ক দফতরের ডেপুটি কমিশনার অরূপ ঠাকুরতার অবশ্য তা নিয়ে বিশেষ হেলোদল নেই। বলছেন, ‘‘আসলে, ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলাটা আমরা তুলে নিয়েছি। তাই যাঁর জিনিস তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়াই তো দস্তুর।’’ তবে, ওই মামলা কেন তুলে নেওয়া হল, কেনই বা আদালতের নির্দেশ ডিঙিয়ে এমন ফরমান জারি, সদুত্তর মেলেনি।
চিড়িয়াখানার কর্তাদের প্রশ্ন, ‘অবৈধ’ ভাবে পশুপাখি রাখা এবং চড়া দামে তাদের বিকিকিনির জন্য যাদের উদ্ধার করে সঁপে দেওয়া হয়েছিল চিড়িয়াখানায়, এই ক’বছরেই তা ‘বৈধ’ হয়ে গেল কোন আইনে?
আড়াই বছর আগের এক দুপুরে, বাগুইহাটির শীর্ণ গলির পেল্লাই বাড়িটায় পা রেখেই শুল্ক কর্তাদের চোখ উঠেছিল কপালে— আটপৌরে বাড়ি কোথায়, এ তো ছোটখাটো একটা চিড়িয়াখানা!
ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন ব্যুরো’র কর্তাদের সঙ্গে নিয়ে শুল্ক দফতরের ঘণ্টা পাঁচেকের তল্লাশিতে সে বাড়ির উঠোন, ঘর, বারান্দা এমনকী ছাদের চিলেকোঠা থেকে একে একে উদ্ধার হয়েছিল খান তিনেক নিতান্তই নাবালক শিম্পাঞ্জি, মারমোসেট বাঁদর, বেশ কিছু কাকাতুয়া, ম্যাকাও, গ্রে প্যারাকিটের মতো আমাজন-জঙ্গলের পাখি। যাদের বাজার মূল্য প্রায় কোটি টাকারও বেশি।
ব্যাঙ্কশাল কোর্টের নির্দেশে সে রাতেই ওই পশুপাখিদের ঠাঁই হয়েছিল কলকাতা চিড়িয়াখানায়।
গত আড়াই বছর ধরে সেই শিম্পাঞ্জিরাই এখন আলিপুরে লোক টানার সেরা বাজি। আর তাদেরই ফেরত দিতে বলছে শুল্ক দফতর?
বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শিম্পাঞ্জি, মারমোসেট বা ম্যাকাও’য়ের মতো পশু-পাখিরা দেশের বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী তালিকায় পড়ে না ঠিকই, তবে তাদের বিপন্ন অবস্থায় উদ্ধার করলে জিম্মাদার অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বন দফতর। এক শীর্ষ কর্তা ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আদালত উদ্ধার হওয়া ওই প্রাণীদের চিড়িয়াখানায় রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ ছাড়া ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই বা উঠছে কী করে!’’
আর ফিরিয়ে দেওয়া হবে কার হাতে? সেন্ট্রাল জু অথরিটির (সিজেডএ) এক কর্তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘বন্য পশুকে ব্যক্তিগত মালিকানায় খাঁচায় এমন কী খোলা এনক্লোজারে রাখা বেআইনি। সিজেডএ-র অনুমোদন ছাড়া তাকে কার হাতে তুলে দেবে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ?’’
সেই উত্তরই হাতড়াচ্ছেন আলিপুরের কর্তারা।