জেলা জেলায়, গ্রাম-গঞ্জের পথে গড়গড়িয়ে চলছে। কিন্তু খাস কলকাতার চৌহদ্দিতে ঢুকে ঢিমে হয়ে গেল রাজ্য সরকারের পড়ুয়া-সাইকেলের গতি। কারণ যাদের জন্য প্রকল্প, সেই স্কুলপড়ুয়াদের অনেকেই সাইকেল চড়তে বিশেষ আগ্রহী নয়।
গ্রামাঞ্চলের মতো কলকাতাতেও সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুল-মাদ্রাসার উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল বিলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। জেলায় সাড়া মিললেও কলকাতায় তার প্রতিফলন নেই। কিছু স্কুলে পড়ুয়ার মতে, তারা সাইকেল নেবে না। কারণ, মহানগরে গণ পরিবহণের সুবিধার সঙ্গে ঘিঞ্জি পথে সাইকেলের ঝুঁকির প্রসঙ্গও উঠে আসছে।
সব মিলিয়ে কলকাতার স্কুলে সাইকেল বিলির যৌক্তিকতা পড়ে গিয়েছে প্রশ্নচিহ্নের মুখে। যদিও প্রকল্প বাতিলের কোনও সম্ভাবনা অন্তত এই মুহূর্তে নেই বলে নবান্ন-সূত্রের খবর। কলকাতার জন্য ৭৬ হাজার সাইকেল বরাদ্দও হয়ে গিয়েছে। শহরে প্রকল্পটি রূপায়ণের ভার পড়েছে কলকাতা পুরসভার উপরে। মূলত গ্রামের গরিবঘরের মেয়েদের স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার্থে সাইকেল বিলি চালু হয়েছিল বাম আমলের শেষ বছরে। গত ক’বছরের মমতা জমানায় তা আরও জোরদার হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে জঙ্গলমহল-সহ বিভিন্ন জেলায়। শুধু ছাত্রী নয়, প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে উঁচু শ্রেণির ছাত্রদেরও। এই ‘সাফল্যের’ প্রেক্ষাপটে এ বার কলকাতায় সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ৫৭৫টি স্কুল ও মাদ্রাসায় সাইকেল বিলির পরিকল্পনা করেছে রাজ্য। দশ ও বারো ক্লাসের সব ছাত্র-ছাত্রীর সাইকেল পাওয়ার কথা।
সেই মতো স্কুলশিক্ষা দফতরকে বলা হয়েছিল নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওই দুই শ্রেণির পড়ুয়াসংখ্যার হিসেব অগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পেশ করতে। সেই তালিকা বানাতে গিয়ে ‘অনীহা’র ইঙ্গিত পেয়েছে সরকার। বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়াদের কথায়ও স্পষ্ট, সাইকেল চড়ে স্কুলে আসায় অনেকেই তেমন উৎসাহ বোধ করছে না। কেন?
কমলা গার্লসের কিছু ছাত্রীর বক্তব্য, ‘‘এখানে সাইকেল চালানো মানে তো সেধে বিপদ ডেকে আনা!’’ আর্যকন্যার ছাত্রীদের যুক্তি, ‘‘শহরে যানবাহনের অভাব নেই। সেখানে খামোকা সাইকেলে চড়ার ঝুঁকি নেব কেন?’’ বাগবাজার মাল্টিপারপাস, আলিপুর মাল্টিপারপাস-সহ আরও কিছু স্কুলের বহু পড়ুয়ার মুখে একই সুর। শুনে শিক্ষা দফতর আতান্তরে। সরকারি কর্তাদের মনে অন্য সংশয়ও উঁকি মারছে। কারণ খোদ পুলিশ কমিশনারের নোটিস মোতাবেক, কলকাতার অন্তত ১৭৪টি রাস্তায় সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ। এ দিকে অন্তত দু’শো স্কুলের অবস্থান সেগুলির উপরে। ‘‘তা হলে সরকার কি পরোক্ষে পড়ুয়াদের উৎসাহ দিচ্ছে বিধি ভাঙতে?’’— প্রশ্ন জেগেছে দফতরের অন্দরে।
লালবাজারের আধিকারিকরা মুখ খুলতে চাননি। এক স্কুলশিক্ষা কর্তার দাবি, যাতায়াতের অসুবিধে কলকাতায় নেই। তবু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অর্থ দফতরের এক আধিকারিকের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সাইকেল পেলে অনেকেই বেচে দেবে। আদতে সরকারের টাকার অপচয়।’’ ভবানীপুরের এক তৃণমূল কাউন্সিলর জানান, গোড়াতেই গলদ।
পুর-কর্তৃপক্ষ কী বলেন? কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বিতর্ক এড়িয়ে বলেন, ‘‘সরকার ঘোষিত নীতিতে পুরসভা নোডাল এজেন্সি হয়ে কাজ করছে।’’ মেয়র পারিষদ (শিক্ষা) অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের মাধ্যমে স্কুলে-মাদ্রাসায় সাইকেল দেওয়া হবে। এ নিয়ে গত ৩ অগস্ট পুরসভায় বৈঠকও হয়ে গিয়েছে।