চন্দ্রকান্ত পাটিল
বিহারের বিধ্বংসী বন্যায় দুর্গতদের চিকিৎসা করতে সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে ছুটে এসেছেন এক তরুণ ডাক্তার। দিনরাত এক করে ত্রাণশিবিরে রোগীদের শুশ্রূষা করে চলেছেন তিনি। হঠাৎ বিনা মেঘে নয়, ঘনিয়ে আসা মেঘ থেকেই বজ্রপাত। মৃত্যু হল তাঁর।
চন্দ্রকান্ত পাটিল নামে ওই তরুণের জন্ম মহারাষ্ট্রের ধুলে-তে। ১৯৮৪ সালে। ডাক্তারি পাশ করার পরে ২০০৮-এ বিহারে বন্যার্তদের সেবা করতে এসে বজ্রাঘাতে যখন মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪ বছর।
চন্দ্রকান্তের অকাল অপঘাত মৃত্যু সামাজিক ও মানবিক ক্ষতি তো বটেই। তার থেকেও বড় কথা, নতুন প্রজন্মের এই ডাক্তারের আত্মত্যাগ আধুনিক চিকিৎসা-দর্শনকে জ্বলন্ত এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। চিকিৎসা কি এখনও সনাতন ভারতীয় সেবাধর্মের অন্যতম অঙ্গ, নাকি তা এখন অর্থের বিনিময়ে ক্রয়যোগ্য পণ্যের অতিরিক্ত কিছু নয়? অর্থাৎ ‘ফেলো টাকা, চিকিৎসা নাও’, নাকি ‘এসো আতুর, আরোগ্য হও’?
এই প্রশ্ন দিয়েই সোমবার স্মরণ করা হল চন্দ্রকান্তকে। এই উপলক্ষে বিতর্কসভার বিষয় ছিল ‘সেবার মন্ত্রোচ্চারণ নয়, শুধুমাত্র আরও বেশি আর্থিক বিনিময়ের মধ্য দিয়েই উন্নত চিকিৎসা সম্ভব’। ‘লিভার ফাউন্ডেশন, পশ্চিমবঙ্গ’ আয়োজিত ওই স্মরণ ও বিতর্কসভায় বক্তা ছিলেন মূলত রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারাই। অকালপ্রয়াত ওই তরুণ চিকিৎসকের স্মৃতি সামনে রেখে ভাবী ডাক্তারেরা সেবার আদর্শকে বরণ করছেন, নাকি অর্থসর্বস্বতাই তাঁদের লক্ষ্য— তার একটা দিশা পেতেই যেন এই তর্কাতর্কির আয়োজন। সভায় বসে যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তি শুনলেন চন্দ্রকান্তের মা লতাদেবী এবং বাবা উমাকান্ত পাটিলও।
ডাক্তারি পড়ুয়াদের মধ্যে যাঁরা বিতর্কসূত্রের পক্ষে দাঁড়ালেন, তাঁরা শুরু করলেন প্রাচীন কাল থেকেই। চিকিৎসকের পেশার বিবর্তন দেখাতে গিয়ে তাঁরা বললেন, শুধু সেবার মানসিকতা নিয়ে আজ আর ডাক্তারি পড়া বা পেশা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। উন্নততর চিকিৎসায় অতি আধুনিক সরঞ্জাম আর ওষুধের জন্য চাই প্রভূত অর্থ। সেই ওষুধ ও সরঞ্জাম নিয়ে যাঁরা চিকিৎসা করবেন, তাঁদের শ্রম ও কুশলতার বিনিময়েও চাই উপযুক্ত পারিশ্রমিক।
সেবা আর চিকিৎসা পরিষেবার মধ্যে এ ভাবেই একটা ‘তফাত’ গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন ওই বক্তারা। জানালেন, চিকিৎসাশাস্ত্রের সেবাদর্শ এবং ফলিত চিকিৎসার বিবর্তনের সূত্রেই তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে জুড়ে যায় অর্থ। রাজতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিলেন রাজবৈদ্যেরা। রাজাদের তরফে চিকিৎসকদের দেওয়া নজরানা, অর্থ বা পুরস্কারের মধ্যেই চিকিৎসায় আর্থিক বিনিময়ের বীজ বপন হয়েছিল। ধীরে ধীরে চিকিৎসা হয়ে ওঠে আবশ্যিক পণ্য।
ওই বক্তারা জানান, চিকিৎসক হয়ে ওঠার পর্বে যে-বিপুল টাকা খরচ হয়, আর্থিক বিনিময় ছাড়া পরে তা উসুল করে নেওয়ার পথ নেই। এক শ্রেণির রোগী বা তাঁদের পরিজনদের মানসিকতাও ‘ফেলো টাকা, নাও চিকিৎসা’র সমর্থক। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে যে-চিকিৎসা দেওয়া হয়, তাতে সন্তুষ্ট না-হয়ে তাঁরা ছোটেন ঝাঁ-চকচকে বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালে। এমনকী রোগীদের একাংশের ধারণাই জন্মে গিয়েছে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বিশেষ জোটে না। বেঘোরে মারা যায় রোগী। সরকারি হাসপাতালে রোগী-মৃত্যুর বিভিন্ন ঘটনায় চিকিৎসকদের হেনস্থা এই ধারণাকে পুষ্ট করেছে। ওই বক্তাদের সিদ্ধান্ত, চিকিৎসাও পণ্য। বড়জোর বলা যায়, সেবা-পণ্য। সেই পণ্য পাওয়ার জন্য আর্থিক বিনিময় চাই-ই চাই। সে-ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে চিকিৎসা প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। যাঁরা টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতে অপারগ, সেই প্রকল্প থেকে তাঁরাও উপকৃত হতে পারবেন।
বিপক্ষের বক্তারা মনে করেন, টাকার বিষয়টি জুড়ে দিলে চিকিৎসার আদি সেবাব্রতের আদর্শই কলুষিত হয়। বিবর্তনের রাস্তা ধরে অর্থ চিকিৎসকের পেশার সঙ্গে জুড়ে গেলেও সেটা শেষ কথা হতে পারে না। শেষ কথা সেবাই। অর্থের প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে নৈতিকতা আর মানবিকতার অবমাননা হচ্ছে। ওই বক্তাদের মতে, আর্থিক বিনিময়ের বিষয়টিকে উপেক্ষা না-করেই সেবাধর্ম পালন করা যায়। টাকা নিলেও কতটা নেওয়া হবে, তার একটি গণ্ডি থাকা দরকার। সেবাকাজ করেন বলেই চিকিৎসক সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের থেকে আলাদা স্থান ও সম্মান পান। চিকিৎসকের পেশায় যাঁরা আসবেন, এটা তাঁদের মনে রাখতে হবে। উন্নত পরিষেবায় অর্থের প্রয়োজন ঠিকই। কিন্তু শুধু ‘আরও বেশি আর্থিক বিনিময়’ এই পেশার আদর্শ ও মহত্ত্বকে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। সেটা যাতে না-হয়, তার জন্য একটি নিয়মনীতি প্রণয়নের প্রয়োজন বলে জানান বিপক্ষের ওই বক্তারা।
পক্ষের বক্তা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সমরজিৎ দাস এবং বিপক্ষ শিবিরের বক্তা এসএসকেএমের ছাত্র রাহুল মান্নাকে পুরস্কৃত করা হয়।
কিন্তু এমন বিতর্ক কেন?
এমন বিতর্ক চিকিৎসা পরিষেবার দিশা ঠিক রাখতে সাহায্য করে, বললেন লিভার ফাউন্ডেশনের সচিব চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী।