রাজ্যের হাসপাতালগুলো আগেই হাত তুলে নিয়েছিল। আদালতের নির্দেশে তাই মাতঙ্গ সিংহকে দেখে গেলেন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এইমস)-এর তিন চিকিৎসক।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারদা-মামলায় গ্রেফতার করা হয় প্রাক্তন মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা মাতঙ্গ সিংহকে। গ্রেফতারের পর থেকেই লিভারের গুরুতর সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছেন তিনি। ২০০৪ সালে লন্ডনের কিঙ্গস হাসপাতালে মাতঙ্গের লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।
কিছু দিন আগে মাতঙ্গের আইনজীবী অনিবার্ণ গুহঠাকুরতা আলিপুর আদালত ও হাইকোর্টে একই সঙ্গে আবেদন জানান, প্রাক্তন মন্ত্রীর শারীরিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। তাই চিকিৎসক দল গঠন করে মাতঙ্গের শারীরিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হোক। রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নেওয়ার পরে সিবিআই-ও আদালতে আর্জি জানায়, এইমসের চিকিৎসক দল দিয়ে মাতঙ্গকে পরীক্ষা করা হোক। দু’পক্ষের আর্জি মেনে গত ৫ অগস্ট হাইকোর্ট এইমসের কয়েক জন চিকিৎসককে নিয়ে একটি কমিটি
গঠন করে মাতঙ্গ সিংহের শারীরিক অবস্থার রিপোর্ট আদালতে পেশ করার নির্দেশ দেয়।
বুধবার বাঘা যতীনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এইমসের লিভার বিশেষজ্ঞ সুজয় পালের নেতৃত্বে তিন সদস্যর চিকিৎসক দল মাতঙ্গকে দেখতে আসেন। মার্চ থেকে মাতঙ্গ ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মাতঙ্গের বিভিন্ন রিপোর্ট পরীক্ষা করেন দিল্লির চিকিৎসকেরা। তাঁর লিভারের কয়েকটি পরীক্ষাও করা হয়েছে বলে ওই হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে।
মাতঙ্গের আইনজীবী চাইছেন, মাতঙ্গের চিকিৎসা হোক দক্ষিণ ভারতের একটি লিভার চিকিৎসা কেন্দ্রে। মাতঙ্গের ব্যক্তিগত চিকিৎসক মহম্মদ হেলা দক্ষিণ ভারতের সেই লিভার প্রতিস্থাপন কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। মাতঙ্গের আইনজীবীর দাবি, তাঁর মক্কেলের লিভারের অবস্থা ক্রমশই খারাপ হচ্ছে। যে হাসপাতালে তিনি ভর্তি রয়েছেন সেখানে তো বটেই, এমন কী রাজ্যের কোনও হাসপাতালেই মাতঙ্গের চিকিৎসার যথাযথ পরিকাঠামো নেই। তাই মহম্মদ হেলার তত্ত্বাবধানে তাঁকে দক্ষিণ ভারতের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। মাতঙ্গকে একজন লিভার বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে একটি লিভার চিকিৎসা কেন্দ্রে পর্যবেক্ষণে রাখার পরামর্শ দিয়ে গত জানুয়ারি মাসে সিবিআইকে চিঠিও দেন হেলা।
সেই চিঠি পেয়েই তৎপর হয় সিবিআই। সুপার স্পেশ্যালিটি সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএম ও কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে মাতঙ্গের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আবেদন জানানো হয়।
ধরা পড়ার পরে দিন কয়েক এসএসকেএমে ভর্তি ছিলেন মাতঙ্গ। জেল হেফাজতে থাকাকালীনও তাঁকে একাধিক বার চিকিৎসার জন্য এসএসকেএমে আনা হয়েছিল। তাঁর চিকিৎসার জন্য একটি মেডিক্যাল বোর্ডও গঠন করা হয়েছিল এসএসকেএমে। সেই বোর্ডের সদস্যরা চিঠি দিয়ে সিবিআইকে জানান, ওই হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পরিকাঠামো না থাকায় মাতঙ্গের চিকিৎসা সম্ভব নয়। কেন ওই কথা লেখা হল? হাসপাতালের অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আমি যত দূর জানি, আমাদের লিভার ইনস্টিটিউটে ওই চিকিৎসার পরিকাঠামো থাকার কথা। কিন্তু চার জন চিকিৎসক যদি চিঠিতে তা না থাকার কথা লিখে থাকেন, তা হলে সেটাকেই সত্যি বলে ধরে নিতে হবে।’’
একই ভাবে চিকিৎসায় অপারগতার কথা লিখিত ভাবে জানিয়েছে অ্যাপোলো গ্লেনিগল্স হাসপাতালও। হাসপাতালের তরফে দাবি, এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা তাদের জানিয়েছিলেন মাতঙ্গ সিংহের ফের লিভার প্রতিস্থাপন করতে হবে। কোনও রোগীর পুনরায় লিভার প্রতিস্থাপনের পরিকাঠামো ওই হাসপাতালে নেই। তাই সিবিআই-এর অনুরোধ মানতে পারেনি তারা। এসএসকেএম অবশ্য দাবি করেছে, পুনরায় লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন বলে কোনও মতামত সেখানকার ডাক্তাররা দেননি।
লিভার প্রতিস্থাপনের পর কোনও জটিলতা হলে তার চিকিৎসার পরিকাঠামো তাদের নেই বলে সিবিআই-কে জানিয়েছে আর এন টেগোর এবং ফর্টিস হাসপাতালও। ওই দুই হাসপাতালের কর্তারাই বলেছেন, ‘‘লিভারের চিকিৎসা আর প্রতিস্থাপনের পরে জটিলতার চিকিৎসা-এই দু’টি বিষয় আলাদা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমাদের পরিকাঠামো এখনও তৈরি নয়।’’
সারদা মামলায় ধৃত একাধিক অভিযুক্ত অসুস্থতার কারণে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এইমসের চিকিৎসকদের নিয়ে একটি দল গঠন করে ধৃতদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার আবেদন করেছিলেন সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার ফণিভূষণ কর্ণা। মাতঙ্গ সিংহ ছাড়া সারদা-কাণ্ডে ধৃত মনোরঞ্জনা সিংহ, রমেশ গাঁধী, সদানন্দ গগৈ ও শান্তনু ঘোষের চিকিৎসার ব্যাপারে এইমসের বিশেষজ্ঞদের মতামতের আবেদন করা হয়েছিল। ৫ অগস্ট হাইকোর্ট রায় দেয়, এইমসের চিকিৎসকরা মাতঙ্গকে দেখে আদালতে রিপোর্ট দেবে ।
সিবিআইয়ের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘এ রাজ্যের সরকারি-বেসরকারি বড় হাসপাতালগুলোতে লিভারের চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা না-থাকাটা খুবই আশ্চর্যজনক।
এই রাজ্যে এক জন বিচারাধীন বন্দি রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না বলেই অন্য রাজ্যের ডাক্তারদের ওপরে ভরসা করার কথা ভাবতে হচ্ছে।’’