মঙ্গলবার ফোনে ‘ঝাড়’ খেয়েছিলেন! পর দিন দিল্লিতে ডেকে ‘ঝাড়’ দেওয়া হয়েছে!
তাঁর জমানাতেই দলের বিধায়ক সংখ্যা ১ থেকে বেড়ে ৩ হয়েছে। ১০ শতাংশের উপরে ভোট পেয়েছে দল। তবুও ঝাড়ের পর ঝাড় খাচ্ছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। এবং ‘ঝাড়’ খাচ্ছেন আর এক গাল হেসে সে কথা বলে বেরাচ্ছেন। দলের ভিতরে, এমনকী বাইরেও।
অদ্ভুত না!
সম্প্রতি দেশপ্রেম বিতর্কে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ও শিক্ষকদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করেছিলেন দিলীপবাবু। ভোটের পর তৃণমূলের সন্ত্রাসের জবাবে আবার তাদের কর্মীদের ‘ঘাড় মটকানো’ এবং ‘বাড়িতে জল বন্ধ’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি। তাই বিতর্ক এখন দিলীপের সর্বক্ষণের সঙ্গী। তাঁর বেফাঁস মন্তব্য নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে যেমন সমালোচনা চলছে। তেমনই অসন্তোষের পাহাড় গড়ে ফেলেছেন রাজ্য নেতাদের একাংশ। রাজ্য সংগঠনে দিলীপবাবুই মাথা। সেজন্য বিহিত চেয়ে কলকাতা থেকে চিঠি গিয়েছে দিল্লির দরবারেও। যে সব অভিযোগের মোটামুটি বক্তব্য, ভোটে সামান্য ভাল ফল হওয়ায় কর্মীরা এখন চাঙ্গা। আগামী দিনে রাজ্যে জমি শক্ত করার কাজ শুরু করার জন্য এটাই সঠিক সময়। এই পরিস্থিতিতে দিলীপবাবুর অশালীন হুমকি দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। বৃহস্পতিবার বিজেপি-র রাজ্য কমিটির বৈঠকেও এ প্রসঙ্গ ওঠে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে সেখানে পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিলেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়।
ওই বৈঠক থেকে বেরিয়েই এ দিন দিলীপবাবু হেসে বলেন, ‘‘দেখুন এখন রোজ ঝাড় খাচ্ছি। ঘাড় মটকে দেব, জল বন্ধ করে দেব— বলেছি বলে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে নালিশ হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে বলা হয়েছে, ওকে বলে দাও, আমাকে সরকার চালাতে হয়। আগের দিন (মঙ্গলবার) যখন বিধানসভায় ছিলাম, তখনই তো রামলালজির (সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক) ফোন পেয়েছি! তার পর দিল্লিতে আমাকে ডেকেও উনি কথা বলেছেন।’’
ইদানিং বিজেপি-র রাজনীতির যাঁরা খোঁজ রাখেন তাঁরা জানেন, কোনও ব্যাপারে দলে অমিত শাহ-র বার্তাই অনেক বড় ব্যাপার। তার ওপর নরেন্দ্র মোদীর তরফে যদি সতর্ক করে দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে আর কোনও কথাই চলে না। এমন বকাঝকা খেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকারই কথা ছিল দিলীপের। কিন্তু কৌতুহল বেড়ে যাচ্ছে, দিলীপবাবুর হাসি দেখে! হেসে হেসে ওই ভর্ৎসনার কাহিনি নিজেই বলছেন ভরা হাটে! ভোটে দাঁড়ানোর পর থেকেই তুরীয় মেজাজে রয়েছেন তিনি। ইদানিং দলীয় অনুগামীদের দেখলেই ভোটের লড়াই পর্বের ছোট-বড় নানা ঘটনা রসিয়ে রসিয়ে বলছেন। আর মাঝে মধ্যেই বলে উঠছেন, ‘‘দারুণ মজা।’’
বিজেপি সূত্রের খবর, আসলে দলের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার জন্যই রামলাল দিলীপবাবুকে ডেকে বলেছেন, কলকাতায় গিয়ে বলুন যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আপনাকে ঝাড় দিয়েছে। রাজ্যের নেতারা তা জেনেই খুশি হবেন। তার পর আপনি সংগঠনের
কাজ যে ভাবে চালাচ্ছেন, সে ভাবেই চালিয়ে যান। দিলীপবাবু সেটাই করছেন। দলের মধ্যে তো বলছেনই, সেই সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকদেরও বলে বেরাচ্ছেন তাঁকে বকা হয়েছে।
বস্তুত, বিজেপি-র এই সাংগঠনিক কৌশলটাও নতুন নয়। এক সময় সাক্ষী মহারাজ-নিরঞ্জন জ্যোতিদের অশালীন মন্তব্যের জন্য জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-র তীব্র সমালোচনা হচ্ছিল। তখন তাঁদের ডেকে এভাবে ঝাড় দিয়েছিলেন অমিত শাহ। বিজেপি সভাপতির বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে দিন সাক্ষী মহারাজ-নিরঞ্জন জ্যোতিরা সবাইকে ডেকে ডেকে বলেছিলেন, আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কদিন যেতেই তাঁরা ফের নানারকম বিতর্কিত মন্তব্য করা শুরু করে দেন। কারণ, সেটাই বিজেপি-র রাজনীতি। জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেমের প্রশ্নে বিতর্ক তৈরি করে সমাজে মেরুকরণ ঘটানো। পর্যবেক্ষকদের মতে, দিলীপবাবুর রাজনীতিও তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কখনও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে, কখনও বা তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি যে উগ্র মন্তব্য করছেন, সেটা আসলে দলের কৌশল। তার মাধ্যমে বাংলায় জনভিত্তি আরও বাড়াতে চাইছেন তিনি। তাতে বাবুল সুপ্রিয় বা রূপায় গঙ্গোপাধ্যায়দের অস্বস্তি হতে পারে, কিন্তু নীচুতলার কর্মীরা এই ভোকাল টনিকেই আরও উজ্জীবিত হচ্ছেন।