থরহরি উত্তর শহরতলি

ওভারটাইম খেটে কাঁপিয়ে দিচ্ছে ডেঙ্গি

পুজোর পরেই জ্বরে পড়েছিলেন। রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ল, ডেঙ্গি হয়েছে নিমতার ওই গৃহবধূর। আইনরক্ষকেরও ছাড় নেই! খাস দমদম থানার দশ জন পুলিশকর্মী ডেঙ্গির শিকার! অপরাধী ধরবে কে?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩৪
Share:

—ফাইল চিত্র।

পুজোর পরেই জ্বরে পড়েছিলেন। রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ল, ডেঙ্গি হয়েছে নিমতার ওই গৃহবধূর। আইনরক্ষকেরও ছাড় নেই! খাস দমদম থানার দশ জন পুলিশকর্মী ডেঙ্গির শিকার! অপরাধী ধরবে কে?

Advertisement

দেখে-শুনে পুলিশকর্তারা প্রমাদ গুনছেন। ব্যারাকপুর কমিশনারেট থেকে ইতিমধ্যে চিঠি গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের কাছে। যার মোদ্দা কথা— অবিলম্বে মশার বংশ ধ্বংস করুন। নচেৎ আইন-শৃঙ্খলা সামাল দেওয়া দায় হয়ে উঠবে।

বর্ষা বিদায় নিয়েছে, কেটে গিয়েছে পুজোও। শীত দূরে নয়। এখনও উত্তর শহরতলিতে ডেঙ্গির রমরমায় যে বিন্দুমাত্র রাশ পড়েনি, উপরের ছবিতেই তা পরিষ্কার। মশাবাহিত রোগটির পরাক্রমে দমদম, উত্তর দমদম, বরাহনগরের বিরাট অঞ্চল রীতিমতো থরহরি। আবার মাঝে কিছুটা কমলেও পুজোর ঠিক আগে থেকে সল্টলেকে ডেঙ্গি ফের কামড় বসিয়েছে। অনেককে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হচ্ছে। সল্টলেক ও বাইপাসের বেসরকারি নানা হাসপাতালে এই মুহূর্তে বিস্তর ডেঙ্গি রোগী ভর্তি, যাঁদের বড় একটা অংশ উত্তর শহরতলির লোক। এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘এ বার ডেঙ্গি যেন ওভারটাইম করছে! এবং এখনও দাপটে কোনও খামতি নেই!’’

Advertisement

দমদম ও উত্তর দমদমের পুর-কর্তৃপক্ষও মানছেন, ডেঙ্গি হচ্ছে। কিন্তু আক্রান্তদের ‘স্থানীয় মশা’ কামড়েছে কি না, সে প্রশ্ন তুলতেও তাঁরা ছাড়ছেন না। ‘‘বাসিন্দাদের অনেকেই তো কাজের সূত্রে বাইরে যান!’’— বলছেন উত্তর দমদমের চেয়ারম্যান পারিষদ (স্বাস্থ্য) মহুয়া শীল। দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ রিঙ্কু দত্তের কথায়, ‘‘পুলিশ ব্যারাকে গিয়ে মশা মারা হয়েছে। দেখতে হবে, আক্রান্ত পুলিশকর্মীরা এই তল্লাটে এসেই ডেঙ্গির কবলে পড়েছেন কিনা।’’

এ হেন কথাবার্তা শুনে এলাকাবাসী তাজ্জব। তাঁদের অনেকের মতে, মশা নিধনে পুরসভা ব্যর্থ। তাই নিজেদের দোষ ঢাকতে এমনতর যুক্তি সাজানো হচ্ছে।

ঘটনা হল, নিজের নিজের এলাকায় ঠিক ক’জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত, উত্তর দমদম বা দমদম পুরসভা তা জানাতে পারেনি। ঠিক যেমন জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে হিসেব নেই, উত্তর শহরতলিতে ডেঙ্গি-রোগীর সংখ্যাটা কত। যদিও উত্তর ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিক প্রলয় আচার্যের দাবি, জেলা জুড়ে ডেঙ্গির প্রকোপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। উত্তর দমদম ও দমদম পুরসভার কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

পুরবাসী কিন্তু প্রশাসনের তরফে গাফিলতিরই আঁচ পাচ্ছেন। জেসপ কারখানা লাগোয়া এলাকা-সহ দমদমের বহু পাড়ায় ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্ত। পুর-সক্রিয়তা বাসিন্দাদের নজরে আসেনি। ডেঙ্গিতে মৃত্যুর সাক্ষী দক্ষিণ দমদম জুড়ে আতঙ্ক বহাল। বরাহনগরে কার্যত প্রতি পাড়ায় আক্রান্ত একাধিক। বরাহনগর পুরসভার খবর: ১, ১৮, ১৭-সহ বেশ কিছু ওয়ার্ডে ডেঙ্গির চোখরাঙানি সবচেয়ে বেশি। কামারহাটির বস্তিতেও তা-ই। উত্তর দমদমে বহু নাগরিকের অভিযোগ, মশানিধনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। তেল ছড়ানো, ধোঁয়া— কিছুই নয়। পুরকর্মীরা ঘুরে ঘুরে মশার লার্ভা খুঁজছেন, এমন দৃশ্যও বিরল। অনেকের আক্ষেপ, ‘‘পুর-হাসপাতালে গেলে বাইরের ল্যাব থেকে ব্লাড টেস্ট করিয়ে আনতে বলা হচ্ছে। এ-ও বলা হচ্ছে, রিপোর্ট পজিটিভ হলে তবেই হাসপাতাল ভর্তি নেবে।’’

কর্তৃপক্ষ অভিযোগ মানতে চাননি। তবে নিমতা, বেলঘরিয়া, দমদম, উত্তর দমদমের বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের তথ্য মোতাবেক, দৈনিক গড়ে অন্তত দশ জন ডেঙ্গি-রোগীর সন্ধান মিলছে। বহু ক্ষেত্রে দোসর হয়ে জুটছে বাড়তি সংক্রমণ। বেলঘরিয়ার এক নার্সিংহোমের ডাক্তার বিনয় গুছাইতের পর্যবেক্ষণ, ‘‘অনেক রোগীর লিভারে গোলমাল ধরা পড়ছে। অন্যান্য সংক্রমণও থাকছে।’’

অন্য দিকে বিভিন্ন পুর-কর্তৃপক্ষের তরফে বাসিন্দাদের মধ্যে ‘সচেতনতার অভাবের’ দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। কী রকম?

পুর-কর্তাদের অভিযোগ: বারবার বলা সত্ত্বেও অনেকে বাড়ির আনাচে-কানাচে জল জমিয়ে রাখছেন। প্লাস্টিক-থার্মোকলের কাপ বা গ্লাস ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র, যাতে জমা জল হয়ে উঠছে মশার আঁতুড়। ছোট-বড় কারখানা বা বেসরকারি অফিসে ঢুকে মশার আস্তানা খুঁজতে অসুবিধে হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পরিচয়পত্র বানিয়েও বিশেষত কলোনি ও বস্তি অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে বাধা আসছে।

এবং এত সমস্যা সত্ত্বেও মশাদমনের উদ্যোগে ভাটা পড়েনি বলে উত্তর শহরতলির বিভিন্ন পুরসভার দাবি। যেমন মহুয়াদেবী বলছেন, ‘‘আমরা বছরভর মশার তেল স্প্রে করি। ইদানীং নিয়মিত কামান দাগা হচ্ছে।’’ রিঙ্কুদেবীর বক্তব্য, দমদমে ডেঙ্গি এখন কব্জায়। বরাহনগর পুরসভা জানাচ্ছে, ডেঙ্গি রুখতে টাস্ক ফোর্স হয়েছে। ‘‘মনে হচ্ছে, মশার চরিত্র বদলের ফলেই রোগের বাড়বাড়ন্ত। তবে সম্প্রতি সচেতনতা প্রচারে মানুষের সাড়া মিলছে।’’— উপলব্ধি বরাহনগরের চেয়ারপার্সন অপর্ণা মৌলিকের। দক্ষিণ দমদমের পুর পারিষদ (স্বাস্থ্য) গোপা পাণ্ডে অবশ্য সাফ বলেন, ‘‘ডেঙ্গি নিয়ে মিডিয়া অপপ্রচার চালাচ্ছে।’’

তবে ডেঙ্গির ফিরে আসার কথা অস্বীকার করছে না বিধাননগর পুরসভা। শুধু তা-ই নয়, অন্যদের উল্টো পথে হেঁটে তারা সামনে আনছে সংক্রমণের তথ্যও। কর্তারা জানিয়েছেন, পুজোর আগে থেকে বিধাননগর পুর-এলাকায় এ পর্যন্ত ১০০ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুর খবর নেই। বিধাননগরের মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায় বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য আলাদা আলাদা মশাবিনাশী কামান কেনা হচ্ছে। মশার লার্ভা খুঁজতে ফের শুরু হয়েছে অভিযান।

আগামী বছরের গোড়ার মধ্যেই বিধাননগরে মশা নিয়ন্ত্রণের পরিকাঠামো ঢেলে সাজার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পুরকর্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন