কড়া নজরদারি, বিভিন্ন জেলার পুলিশ কর্তাদের নিয়ে বৈঠকের পরেও বেআইনি অস্ত্রের বাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসন। সাম্প্রতিক কালে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে খুন-জখমের ঘটনার জেরে সে কথা ভাবতেই হচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট শিবু যাদবের মতো সমাজবিরোধীদের কার্যকলাপ বা সামান্য ঘটনাতেও স্থানীয় নেতাদের মদতপুষ্ট গুণ্ডাবাহিনীর অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনা সাধারণ মানুষকে নিয়মিত আতঙ্কে রাখছে। শাসকদলের বেশির ভাগ নেতা এক সময়ে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতেন। এখন বিধায়ক হোন বা পুরসভার চেয়ারম্যান অনেকেই এক জন সশস্ত্র দেহরক্ষী রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রশ্ন করলেই অনেকেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দিকে। ঠিক যে ভাবে সম্প্রতি শিবু বা তার শাগরেদদের ধরার ঘটনাতেও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দের আঁচ প্রকাশ্যে এসেছে।
পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যারাকপুর কমিশনারেট ঘোষিত হওয়ার দু’বছরের মধ্যে এই শিল্পাঞ্চলে খুন হয়েছেন ১৪১ জন। যার বেশিরভাগই ওয়ান শটারের গুলিতে। বিহারের মুঙ্গের থেকে আসা দেশি রিভলবার বা নকল নাইন এমএম পিস্তলের পাশাপাশি এখন দেদার আমদানি হচ্ছে ওয়ান শটার। অস্ত্র কারবারিদের বিহার-বাংলা লিঙ্কম্যানেরাই কলকাতার আশেপাশে ওয়ান শটার তৈরির কারখানা বানাচ্ছে। শস্তার এই আগ্নেয়াস্ত্রের দাম মাঝে মাঝে ওঠা-নামা করে, বিশেষত ভোটের সময়ে। তা না হলে দেড় থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।
কলকাতা শহর-লাগোয়া ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল ঘন জনবসতিপূর্ণ। যেখানে শুধু ভোটারের সংখ্যাই ২৭,৩০,৬৩৬ জন। অসংখ্য ঘিঞ্জি শহর, ভুলভুলাইয়ার মতো রাস্তা। এক দিকে হুগলি নদী। নদী পেরোলেই হুগলি আর অন্য দিকে নদিয়া। সেখান দিয়ে আবার বাংলাদেশেও যাওয়া যায়। একবার পেরিয়ে গেলে আর টিকিটুকু ধরার জো নেই।
শিল্পাঞ্চলের সীমান্ত এলাকা এবং কামারহাটি, জগদ্দলে ওয়ান শটারের বিকিকিনি যে চলে, সে খবর ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা দফতরের কাছে আছে। ২০১১ সালের জুন মাসে বেলঘরিয়া আর খড়দহ থানার সীমানায় থাকা কামারহাটিতে একটি অস্ত্র কারখানার হদিশও পেয়েছিল পুলিশ। বাড়ির পিছনে লেদ কারখানা। ছোটখাটো যন্ত্রাংশ তৈরি হয় সেখানে, এমনটাই ধারণা ছিল এলাকার লোকজনের। কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে যে অস্ত্রও তৈরি হচ্ছে, তা দেখে পুলিশেরও চক্ষু চড়কগাছ। লেদ কারখানায় তৈরি ওয়ান শটার বা পাইপগানের গুলি সস্তাও বটে। পুলিশের থ্রি নট থ্রি রাইফেলে যে গুলি ব্যবহার করা হয়, সেগুলিও এতে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া, ৭.৮৬ ক্যালিবারের পিস্তলের গুলিও ব্যবহার করে অনেকে। নতুন কেনারও প্রয়োজন নেই। ব্যবহৃত গুলির খোলে বারুদ ঠেসে ‘রিফিল’ করা হয় একেবারে দেশীয় প্রক্রিয়ায়। গুলির মুখের সরু অংশটা সিল করে দেওয়া হয়। মাঝে মধ্যে এক আধটা গুলি পাইপগানের মধ্যেই যে ফাটবে না, এমন গ্যারান্টি অবশ্য এই সস্তার অস্ত্রে নেই। তা জেনেই কেনে ব্যবহারকারীরা। যত না গুলি চালানোর জন্য, তার থেকেও বেশি ভয় দেখাতে। সস্তার এই আগ্নেয়াস্ত্র পথে বসিয়েছে মুঙ্গেরের ইমপ্রোভাইজড ঝাঁ চকচকে নাইন এমএমকে।
মুঙ্গেরের বাজার যদি পড়তি হয়, তবে কোন এলাকায় তৈরি ওয়ান শটারের বাজার বাড়ছে? পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্তাদের বক্তব্য, মূলত মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, হুগলিতে তৈরি হচ্ছে এই সব অস্ত্র ও গুলি। মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে ধরপাকড়ও হয়। কিন্তু ছোট লেদ মেশিনের সাহায্যে ঘুপচি ঘরেও তৈরি করা যায় এই অস্ত্র। ফলে গ্রামে-গঞ্জে কোথা বসে তৈরি হচ্ছে সে সব, তা জানতে সত্যিই কালঘাম ছোটে। তা ছাড়া, অস্ত্র কেনাবেচার জন্য বিশাল চক্র আছে। তাদেরও কেউ কেউ মাঝে মধ্যে ধরা পড়লেও বহু মানুষ এই ব্যবসায় যুক্ত হয়ে পড়ায় সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা দিন দিন মুশকিল হয়ে উঠছে।
অস্ত্র পাচারের অভিযোগে ধরা পড়ে জেল খেটে বেরোনো বিহারের এক বাসিন্দার বক্তব্য, ‘‘মুঙ্গেরের অস্ত্র ব্যবসা মার খাচ্ছে স্থানীয় কারখানায় তৈরি ওয়ান শটারের জন্য। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ও কম। কারণ সস্তার আগ্নেয়াস্ত্র কাজ হয়ে গেলে ঝোপে, জলায় ফেলে দিয়ে সহজে গা ঢাকা দেওয়া যায়। বয়ে বেড়ানোর বালাই নেই। দ্রুত প্রমাণ লোপাট।’’ তাই দুষ্কৃতীদের হাতে দেদার ঘুরছে এই ওয়ান শটার, চলতি ভাষায় যার নাম ‘কাট্টা’।
গোয়েন্দা দফতরের রিপোর্ট বলছে, শিল্পাঞ্চলের ১২টি থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে বা কোনও ঘটনার তদন্তে নেমে গত দু’বছরে প্রায় তিনশো এমন অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। গুলি পাওয়া গিয়েছে প্রায় ৭০০ রাউন্ড। ২০১১ সালে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যারাকপুরে খুন হয়েছিল ৮৩টি। আর অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল ১৩৬টি। কমিশনারেট হওয়ার পরে খুনের সংখ্যায় বিশেষ হেরফের হয়নি। অস্ত্রের কারবারও চলছে রমরমিয়ে।
শিল্পাঞ্চলে অপরাধমূলক কাজকর্ম দমন করতে কমিশনারেট গঠিত হওয়ার আগেই তৈরি হয়েছিল এসওজি (স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ)। থানার পিসি (প্লেইন ক্লোদ) পার্টির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এসওজি কাজ করত। কমিশনারেট হওয়ার পরে গোয়েন্দা দফতরকে ঢেলে সাজার কথা বলা হয়।
এসওজি’র ভূমিকাও কমে যায়। কিন্তু দু’বছরের মধ্যে পাঁচ বার গোয়েন্দা প্রধান বদল করা হলেও গোয়েন্দা দফতরের হাল ফেরেনি বলে অভিযোগ। উল্টে এখন এই দফতরের অবস্থা ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো। থানাগুলিতেও ব্যাপক রদবদল হয়েছে। কিন্তু তার ফলে পুলিশের নিজস্ব ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’ কমেছে বলে অভিযোগ পুলিশ মহলেরই একাংশের।
গত বছর ১৯ জানুয়ারি হালিশহরে বিয়ের আসরে বরকে গুলি করে পাত্রীর প্রণয়ী। গণপিটুনিতে সে মারা যায়। যে ওয়ান শটার থেকে গুলি করা হয়েছিল, সেটি উদ্ধার করে পুলিশ। তার দু’দিন পরেই নৈহাটিতেও এক জমির দালাল খুন হন। টিটাগড়ে এমকো চটকলের কুলি লাইনে ছোটদের মধ্যে খেলা নিয়ে বচসার জেরে ১৪ বছরের এক কিশোর তার তরুণ সঙ্গীকে নিয়ে হামলা চালায় একটি বাড়িতে। সাত বছরের এক বালককে গুলি করে খুন করা হয়। আততায়ী আগ্নেয়াস্ত্র-সহ ধরা পড়ে। এ ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়েছিল সেই সস্তার ওয়ান শটার। ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যারাকপুরের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার, বর্তমানে আইজি দক্ষিণবঙ্গ সঞ্জয় সিংহ নিজেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনিও বলেন, ‘‘বেআইনি অস্ত্র ঢুকছে। কিন্তু কী ভাবে তা আসছে শিল্পাঞ্চলে, তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।’’
চলতি বছরে বেশ কয়েক বার শুধু টিটাগড়েরই বিভিন্ন জায়গা থেকে ওয়ান শটার ও গুলি আটক হয়েছে। যা এই অঞ্চলে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ আমদানি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। পুলিশের একাংশের অভিযোগ, শাসক দলের কয়েক জন নেতার মদতেই স্থানীয় দুষ্কৃতীদের হাতে ওয়ান শটারের ছড়াছড়ি। খুন করে আগ্নেয়াস্ত্রটি ফেলে দিতেও গায়ে লাগছে না। আগে বিহার থেকে আনানো পিস্তল বা রিভলবার ১০-২৫ হাজার টাকা খরচ করে কিনতে হত। কিন্তু এখন সে সবের বালাই নেই। ওই টাকায় বস্তা-ভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যাবে। পুলিশ কর্তারা এখন ভাবছেন ওয়ান শটারের বাজার আটকাবেন কী ভাবে!