কংগ্রেস এবং সিপিআইয়ের দেওয়াল লিখছেন সুবীর মিত্র ।
লাল কালি দিয়ে সাদা দেওয়ালে সকাল সকাল লিখেছেন, “দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে একটি ভোটও দেবেন না।” বিকেল গড়াতে সেই একই হাত তুলে নিল সবুজ কালি। লিখে ফেলল, “গণতন্ত্রের স্বার্থে ঘাসফুল চিহ্নে বোতাম টিপে বিপুল ভোটে জয়ী করুন তৃণমূল প্রার্থীকে।”
একই শিল্পী। বয়ান বদলে যায় বেলা গড়ালেই। সেটা বিলক্ষণ জানেন সব দলের নেতারাও। কিন্তু উপায় কী? একটা সময় ছিল যখন ডান-বাম নির্বিশেষে সব দলের কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই ছিলেন এক এক জন দেওয়াল লিখনে ওস্তাদ। দিন জেগে রাত জেগে তাঁরাই পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে দেওয়াল লিখে বেড়াতেন। রাজনীতির সেই উন্মাদনা এখন অনেকটাই ফিকে। একই পেশাদার শিল্পীকে তাই টাকার বিনিময়ে দেওয়াল লেখার জন্য ভাড়া করছে বিভিন্ন দল। সেই সব হাতেগোনা কয়েক জন শিল্পীর তুলিতেই তাই ধরা দিচ্ছে পরস্পর যুযুধান একাধিক প্রার্থীর দেওয়াল-প্রচার।
স্মরজিৎ নাথের তুলিতে দেওয়ালে তৃণমূল এবং বিজেপির প্রচার।
বাদুড়িয়ার বাসিন্দা সুবীর মিত্রকে এলাকায় সকলে রন্টুদা বলেই চেনে। আগাগোড়া বামপন্থী এই মানুষটি দলের হয়ে দেওয়াল লিখে লিখেই শিল্পীর তকমা পেয়েছেন। এক সময়ে শুধু বামপ্রার্থীদের হয়েই দেওয়ালে লাল কালির আগুন ঝরাতেন। এখন সংসার খরচ টানতে নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে কিছুটা পিছনের সারিতে পাঠিয়ে তৃণমূল-বিজেপি-কংগ্রেস সব দলের ডাকেই সাড়া দেন। সকলের হয়েই দেওয়াল লেখেন। বললেন, “একটা সময় ছিল যখন এক দলের দেওয়াল লেখক অন্য দলের হয়ে দেওয়াল লিখতই না। তখন দেওয়াল লেখার সময়ে একটা হইহই রইরই চলত। কত কর্মী-সমর্থক জুটে যেত। প্রার্থীরা নিজেরাও কত সময়ে এসে দাঁড়াতেন কাছে। সে একটা উৎসব ছিল। এখন সে সব কোথায়!” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুবীরবাবু বলে চলেন, “রাতে হ্যারিকেন, হ্যাজাক এমনকী টর্চের আলোতেও দেওয়াল লিখেছি। এখন তো রাতে ব্যাটারির লাইট ধরার লোকই জোটে না।” আট জনের সংসারটা সুবীরবাবুর রোজগারেই চলে। জানালেন, এক দলের হয়েই যদি লেখেন, তা হলে আর পেট চলবে না। তাই এখন যে সব দলের হয়েই লেখার কাজ করেন। আট ঘণ্টা লেখার জন্য মেলে মোটামুটি হাজার খানেক টাকা। রঙের খরচ বাদ দিয়ে শ’পাঁচেক থাকে হাতে।
তবে এটা গ্রামের দিকের হিসেব। শহরে দেওয়াল লিখলে কিছু বেশি টাকা মেলে। দেওয়ালে চুন লেপা আর রং-তুলির খরচ পার্টির। তা বাদে এক ঘণ্টা লিখলে পাওয়া যায় ৭৫-৯০ টাকা। বসিরহাটের খোলাপোতার বাসিন্দা সুরজিৎ নাথ বলেন, “আগে এক জন শিল্পী একটি দলের হয়েই লিখতে পারত। এখন অবস্থা বদলেছে। আগের মতো লোক পায় না দলগুলি। সে জন্য আমাদের মতো শিল্পীদের সাহায্য নেয় সব দল। আমাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মত কী, তা-ও জানার দরকার পড়ে না। পুরোটাই ব্যবসায়িক ভাবে কাজ হয়।” সুরজিৎবাবু জানালেন, দিনে বিজেপি আর রাতে তৃণমূলের হয়ে দেওয়াল লিখছেন। ডাক পেয়েছেন সিপিএমের কাছ থেকেও। এতে রোজগার বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু একটা আফশোস শিল্পীদের। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেওয়ার মতো লোকের বড় অভাব। কাজ ভাল হলে কেউ তারিফও করে না।
নিশিগোপাল মিত্রের মতো কয়েক জন শিল্পীও জানালেন দেওয়াল লেখার কাজ, কার্টুন দেখার জন্য লোকের যে উৎসাহ ছিল, সেটা ইদানীং একেবারেই ফিকে হয়ে গিয়েছে।
ছবি: নির্মল বসু।