প্রায় দেড় মাস লাগাতার প্রচারের পরে আজ, সোমবার ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন বনগাঁ কেন্দ্রের মানুষ। এই দেড় মাসে স্থানীয় নানা সমস্যা নিয়ে প্রতিশ্রুতির বন্যা ছুটিয়েছে সব রাজনৈতিক দলই। কিন্তু এই এলাকার অন্যতম বড় দু’টি সমস্যার কথা সে ভাবে শোনা গেল কই? তা হলে কি যশোহর রোড সম্প্রসারণ বা আর্সেনিক দূষণ রোধ এ বারও গুরুত্ব পাবে না? প্রশ্নটা ঘুরছে বহু ভোটারের মনেই। তাঁরা বলছেন, এই দুই সমস্যা সমাধানে কোনও প্রতিশ্রুতি সে ভাবে মেলেনি। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মধ্যে কাজিয়াতেই বেশি ব্যস্ত থেকেছে।
বনগাঁ ছাড়াও বারাসত এবং দমদম লোকসভা কেন্দ্রের মানুষের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম যশোহর রোড বা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক। ওই রাস্তা সম্প্রসারণের দাবি তাঁদের দীর্ঘদিনের। কেননা, ওই সড়কে দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ঘটনা। দু’ধার জবরদখল হয়ে যাওয়ায় সঙ্কীর্ণ হয়েছে রাস্তা। তার মধ্যেই বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চলে। হাবরা ও বনগাঁয় ওই রাস্তায় যানজটে পড়ে দীর্ঘক্ষণ নাকাল হন যাত্রীরা। বারাসত থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার অংশে সড়কটি এখন পুরোপুরি মৃত্যু-ফাঁদ। তাই, কলকাতা যাতায়াতে অন্যতম ভরসা এই সড়কটি এড়িয়ে মানুষ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে যাতায়াত করছেন ঘুরপথে। সড়কটি সম্প্রসারণের চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। কয়েক বছর আগে বাম আমলে বারাসত থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত যশোহর রোডের বিকল্প হিসেবে ‘ইস্ট-ওয়েস্ট করিডর’-এর জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। সাড়ে ৬২ কিলোমিটার লম্বা এবং ২৭ মিটার চওড়া বিকল্প রাস্তাটির জন্য ২০০৫ সালে ডিসেম্বরে জমি মাপজোকের কাজ শুরু হয়। কিন্তু চাষিদের বাধা ও তৃণমূলের ‘অসহযোগিতা’য় কাজ আর হয়নি।
“যশোহর রোড নিয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ভোট হারানোর ভয়ে রাজনৈতিক দলগুলি জবরদখল
সরাতে উদ্যোগী হয় না। উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতি করে। তাই এ বারও ভোটের প্রচারে বিষয়টি
সে ভাবে উঠে এল না। আর্সেনিক নিয়ে সাধারণ মানুষের বক্তব্য, সরকারি স্তরে
ঢিলেঢালা মনোভাবের জন্যই সমস্যা এখনও মিটল না।”
বনগাঁ থেকে কলকাতায় ওই পথে নিয়মিত যাতায়াত করেন অরূপ ভট্রাচার্য, বনি সিংহেরা। তাঁরা বলেন, “এখন বনগাঁ থেকে কলকাতা যেতে গাড়িতে সকালের দিকে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়। অনেক সময়ই কাজ পণ্ড হয়।” তাঁরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলি তাদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে ভোগান্তি কমবে না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ভোট হারানোর ভয়ে রাজনৈতিক দলগুলি জবরদখল সরাতে উদ্যোগী হয় না। উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতি করে। তাই এ বারও ভোটের প্রচারে বিষয়টি সে ভাবে উঠে এল না।
তৃণমূল অবশ্য দাবি করেছে, কয়েকটি সভায় ওই সড়ক সম্প্রসারণের নানা দিক নিয়ে তারা আলোচনা করেছে। তবে, দলীয় প্রার্থী কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের মুখে এ নিয়ে কিছু শোনা যায়নি। দলের জেলা পর্যবেক্ষক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, “দলের অবস্থান খুবই পরিষ্কার। ওই সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জোর করে চাষিদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না।’’ তা হলে সড়ক কী ভাবে সম্প্রসারণ সম্ভব? মন্ত্রী জানান, ওই সড়কের দু’ধারে থাকা গাছ কাটা হবে। জবরদখলে থাকা সরকারি জমি নেওয়া হবে। তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে। তাঁর দাবি, “কেন্দ্রের তরফে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। মাপজোক করে তাদের কাছে রিপোর্ট পাঠানো হবে। ওই কাজে কেন্দ্র ৬৫ শতাংশ এবং রাজ্য ৩৫ শতাংশ অর্থ দেবে। রাজ্য ওই প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।”
বনগাঁর সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাস বলেন, ‘‘দু’একটি সভায় আমরা যশোহর রোড সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছি। আসলে ওই সমস্যা জটিল। তৃণমূলের জন্যই সমস্যা মিটছে না।” একই দাবি কংগ্রেসেরও। বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস অবশ্য বলেন, “ওই রাস্তা সম্প্রসারণ নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিলে তা মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াত। তবে, চেষ্টা করব সমস্যা সমাধানের।”
আর্সেনিক দূষণও এই এলাকার বড় সমস্যা। শুধু বনগাঁ নয়, ‘আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি’র দাবি, জেলার ২২টি ব্লকেই কমবেশি আর্সেনিক দূষণের সমস্যা রয়েছে। প্রথম সারিতে গাইঘাটা ব্লক। ১৯৯৮ সাল থেকে এখনও এই ব্লকে আর্সেনিক দূষণে মারা গিয়েছেন ১৭ জন। ওই সময়ের মধ্যে গোটা জেলায় মৃতের সংখ্যা ২৫০। শরীরে উচ্চ মাত্রায় আর্সেনিক দূষণের কারণে জেলায় অসুস্থ প্রায় দু’হাজার মানুষ। কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাসের অভিযোগ, “সরকারি স্তরে ঢিলেঢালা মনোভাবের জন্যই সমস্যা এখনও মিটল না। প্রশাসনিক তত্পরতারও অভাব রয়েছে।” আর্সেনিক দূষণের শিকার বেশ কিছু গ্রামবাসী জানিয়েছেন, তাঁরা যথাযথ সরকারি চিকিত্সা পান না।
তিনি যে প্রচারে এই দূষণ নিয়ন্ত্রণের কথা তোলেননি, তা মেনে নিয়েছেন বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী কে ডি বিশ্বাস। তিনি বলেন, “আমার লোকসভা এলাকায় গাইঘাটা ছাড়া আর্সেনিক দূষণের সমস্যা তেমন নেই। তবে প্রচারে বলা উচিত ছিল।’’ সমস্যার কথা মেনে সিপিএম প্রার্থীও স্বীকার করেছেন, “আর্সেনিক সমস্যার কথা সে ভাবে তোলা হয়নি। তবে, দু’একটি এলাকায় গিয়ে বলেছি।” কংগ্রেসের ইলা মণ্ডলও বলেন, “সমস্যাটার সমাধান সহজ নয়। তাই সে ভাবে কোনও প্রতিশ্রুতি দিইনি।”
রাজ্যের শাসক দল অবশ্য দাবি করেছে, আর্সেনিক সমস্যা মেটাতে তারা সচেষ্ট। সে কথা কয়েকটি সভায় বলাও হয়েছে। বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক সুরজিত্ বিশ্বাস বলেন, “গত তিন বছরে আমার বিধানসভা এলাকায় ২২১টি আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ বসেছে।” জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানান, জেলাতে এই সমস্যা মেটাতে নৈহাটিতে ২৭ একর জমি কেনা হয়েছে। সেখানে একটি প্রকল্পের মে মাসের শেষে শিলান্যাস হবে। সেখান থেকে গঙ্গার জল তুলে পরিশোধন করে ব্যারাকপুর-আমডাঙা-হাবরা-অশোকনগর-গাইঘাটা হয়ে ওই জল বনগাঁয় আসবে।” তবু যেন সংশয় কাটছে না ভোটারদের।