আতঙ্কিত বৃদ্ধ।—নিজস্ব চিত্র।
প্রতিবেশীদের ঘরের দরজার বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়ে একটি বাড়িতে হানা দিল দুষ্কৃতীরা। ডাকাতি করতে এসে প্রবীণ গৃহকর্তা ও তাঁর স্ত্রীকে বেধড়ক মারধর করেছে তারা। কয়েক ভরি সোনা-রুপোর গয়না হাতিয়ে নিয়ে পালায়। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে স্বরূপনগর থানার নির্মাণ গ্রামে। ওই দম্পতিকে ভর্তি করা হয়েছে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রাত ২টো নাগাদ ৮-১০ জনের দুষ্কৃতী দলটি মুখে কাপড় বেঁধে হাজির হয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষাকর্মী ফণীশঙ্কর রায়ের বাড়িতে। সকলেই তখন ঘুমাচ্ছিলেন। দুষ্কৃতীরা বাড়ির পিছন থেকে ঢুকে গ্রিলের দরজা ভেঙে দোতলায় ওঠে। সেখানে তখন দু’বছরের মেয়ে দেবস্মিতাকে নিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন ফণীশঙ্করবাবুর ছেলে শিবশঙ্কর ও তাঁর স্ত্রী বনানী। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঘরে ঢুকে দুষ্কৃতীরা তাঁদের ঘুম থেকে ডেকে তোলে। চিৎকার করলে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। সকলের সঙ্গেই আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ছিল বলে জানা গিয়েছে। ভয়ে সিঁটিয়ে যান শিবশঙ্করবাবুরা। তারপরেও তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে দুষ্কৃতীরা। স্বামীর এই অবস্থা দেখে দুষ্কৃতীদের কথা মতো চাবি দিয়ে আলমারি খুলে দেন বনানী। ওই ঘর থেকে সর্বস্ব লুঠ করার পরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসে দুষ্কৃতীরা। শিবশঙ্করবাবুদের নামতে বারণ করে তারা। একটি ঘরে শুয়েছিলেন ফণীশঙ্করবাবু ও তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যাদেবী। ওই ঘরে ঢোকে ডাকাতরা।
পুলিশ জানায়, ঘুম ভেঙে সামনে দুষ্কৃতীদের দেখে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন সন্ধ্যাদেবী। দুষ্কৃতীরা যত তাকে কান্না থামাতে বলে, মহিলা তত জোরে কেঁদে ওঠেন। ডাকাতেরা ওই মহিলাকে বেদম পেটায়। রিভালবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। মাথা ও কপাল ফেটে যায় সন্ধ্যাদেবীর।
স্ত্রীর অবস্থা দেখে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন বৃদ্ধ। দুষ্কৃতীদের একজন তাঁকে ভোজালি দিয়ে ঘা মারে। ফণীশঙ্করবাবুর একটি চোখের পাশ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ওই অবস্থাতে স্বামী-স্ত্রীকে আরও এক দফা মারধর করে ঘরের জিনিসপত্র লুঠ করে বেরিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।
তত ক্ষণে প্রতিবেশীদের কারও কারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বের হতে গিয়ে তাঁরা দেখেন, বাইরে থেকে অনেকের দরজায় শিকল তোলা। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখা যায়, সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা টহল দিচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যে স্বপন গায়েন নামে এক জন কোন রকমে বাইরে বেরোন। কিন্তু এক দুষ্কৃতী তাঁকে হুমকি দিয়ে বলে, এক্ষুণি ঘরে না ঢুকলে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হবে। বাধ্য হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন তিনি। তবে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকেই টেলিফোনে খবর যায় পুলিশের কাছে। রাতেই তদন্তে আসে তারা। কিন্তু তত ক্ষণে পায়ে হেঁটেই পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা।
রাতেই ফণীশঙ্করবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে ভর্তি করা হয়েছিল বসিরহাট হাসপাতালে। সেখান থেকে বুধবার ছেড়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধকে। কিন্তু এখনও ভর্তি তাঁর স্ত্রী। বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। বমিও হচ্ছে। ফণীশঙ্করবাবু বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীদের ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে সন্ধ্যা চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে। বারণ করলে আরও ভয় পেয়ে যায়। তা দেখে দুষ্কৃতীরা আমাদের বেপরোয়া ভাবে মারধর করে। স্ত্রী এবং আমার কপালে রিভলবার ও ভোজালির বাঁট দিয়ে আঘাত করে।”
বুধবার সকালে গ্রামে গেলে দেখা গেল, তখনও কাঁদছেন বনানী। ফণীশঙ্করবাবুর আক্ষেপ, “এত বার করে ওদের বললাম, যা আছে সব নিয়ে যাও। কিন্তু আমাদের মেরো না। কিন্তু কোনও কথাই শুনল না দুষ্কৃতীরা।” তিনি জানান, স্ত্রীর হাতের-কানের অলঙ্কার খুলে কোথায় রাখা আছে, তা জানতে চেয়েছিল ওরা। নগদ ৫০ হাজার টাকা নিয়েও খোঁজ নেয়। কিন্তু এত টাকা যে সত্যিই বাড়িতে নেই, সে কথাটা বিশ্বাসই করতে চাইছিল না ওরা। তারপরেই চপার নিয়ে হামলা চালায় আমার উপরে।” বাঁ চোখে দেখতে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন ফণীশঙ্করবাবু।
স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী এই এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য দীর্ঘ দিনের। লুঠপাট, তোলাবাজির ঘটনা মাঝে মধ্যেই ঘটে। কিছু দিন আগে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে মারধর করে কয়েক লক্ষ টাকা লুঠ করে পালায় দুষ্কৃতীরা। মহিলাদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করা হয়। সেই ঘটনার কোনও কিনারা হয়নি এখনও। মঙ্গলবার রাতের ঘটনায় পুলিশ এসে ঘুরে গেলেও বুধবার রাত পর্যন্ত ধরা পড়েনি কেউ। স্থানীয় মানুষ আতঙ্কিত। তাঁদের বক্তব্য, বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরাও এই এলাকায় ঢুকে অপারেশন চালায়। আবার অপরাধ করে বাংলাদেশে পালায় তারা। পুলিশ ও বিএসএফ আরও সক্রিয় না হলে এলাকায় শান্তিতে বসবাস করাই ক্রমশ মুশকিল হয়ে পড়ছে।