ভরসা দিতে এসেছি, আমডাঙায় বললেন বিমান

দলের নেতাদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আমেনা বিবি। জানালেন, ক’দিন আগে ছেলেকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে শাসক দলের দুষ্কৃতীরা। জখম হয় ছেলে। দোষীদের কাউকে না ধরে ছেলে আসগর আলি ও তাঁর বাবা আসমতকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৪ ০১:০৫
Share:

দলের প্রহৃত কর্মীর বাড়িতে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান।—নিজস্ব চিত্র।

দলের নেতাদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আমেনা বিবি। জানালেন, ক’দিন আগে ছেলেকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে শাসক দলের দুষ্কৃতীরা। জখম হয় ছেলে। দোষীদের কাউকে না ধরে ছেলে আসগর আলি ও তাঁর বাবা আসমতকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙার বোদাই গ্রামে গিয়ে এই ঘটনা শুনে দৃশ্যতই বাকরুদ্ধ বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। ধীরে ধীরে আমেনার মাথায় হাত বোলালেন। তখনও কাঁদছেন মধ্যবয়সী ওই মহিলা।

Advertisement

এ দিন বারাসতে সিপিএমের জেলা কার্যালয় থেকে আমডাঙার গ্রামে যখন পৌঁছন বাম নেতারা, তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকেল সওয়া ৪টে। অসহ্য গরমে দরদর করে ঘামছেন সকলে। বিমানবাবুর সঙ্গে ছিলেন সিপিএম নেতা রবিন দেব, রঞ্জিত্‌ কুণ্ডু, তড়িত্‌বরণ তোপদার, সিপিআই নেতা মঞ্জুকুমার মজুমদার, সিপিআইয়ের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, আরএসপির ক্ষিতি গোস্বামী, ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য জয়ন্ত রায় প্রমুখ।

বোদাই গ্রামে আয়ুব আলির বাড়িতে ঢোকেন বিমানবাবুরা। দিন পনেরো হল শয্যাশায়ী ওই ব্যক্তি। তাঁর বৌমা আরেফা বিবি জানালেন, তৃণমূলের লোকজন ভাসুরমশাইকে বাড়ি ফেরার পথে প্রবল মারধর করে। ইট দিয়ে ঘা মারা হয়। এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা নেই প্রৌঢ়ের। তাঁর কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা কেড়ে নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ পরিবারটির। অস্ফূট স্বরে আয়ুব জানান, সিপিএমকে ভোট দেওয়ার জন্যই তাঁকে এ ভাবে মারধর করা হয়েছে। গ্রামের মানুষ জানালেন, লোকসভা ভোটের পর থেকেই তৃণমূলের হুমকি, শাসানি, মারধর, বোমাবাজি চলছে। এখনও পর্যন্ত গ্রামের ২৫ জন প্রহৃত। ১৬টি বাড়িতে ভাঙচুর করেছে শাসক দলের কর্মী-সমর্থকেরা। হজরত আলির কথায়, “গত কয়েক দিন ধরে গ্রামছাড়া আছি। আপনারা আসবেন জেনেই আজ গ্রামে এলাম।” গ্রামের লোকজন বিমানবাবুদের নিয়ে যান ফসলের খেতে। দেখা যায়, প্রবল গরমে শশা নষ্ট হচ্ছে গাছেই। তৃণমূলের হুমকিতে ফসল কাটা যাচ্ছে না অভিযোগ। দেখা গেল, শ্যালো মেশিনের জলের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। সিপিএম পরিবারগুলিকে ভাতে মারারও তাল করছে তৃণমূল, অভিযোগ উড়ে এল গ্রামের লোকের মধ্যে থেকে।

Advertisement

টেঙাটেঙিতে বেশ কিছু লোকজন জড়ো হয়েছিলেন আগে থেকেই। বোদাই থেকে সেখানে বিমানবাবুদের কনভয় পৌঁছতেই তাঁরা অভিযোগ জানাতে থাকেন নেতাদের ঘিরে। গত পঞ্চায়েত ভোটের দিন এখানেই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে বোমার আঘাতে খুন হয়েছিলেন সিপিএম কর্মী মাদারবক্স আলি। তারপর থেকেই শাসক দলের সন্ত্রাস চলছে বলে জানালেন স্থানীয় মানুষ। এখনও চাপা সন্ত্রাসের পরিবেশ আছে বলে তাঁদের দাবি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পথ আটকে চলছে শাসানি। কাউকে কাউকে সিপিএম করার অপরাধে জরিমানাও করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। জাকির হোসেন মোল্লা, আকবর মণ্ডলরা জানান, পাশের গ্রাম বেলু কাহারপাড়াতেও চলছে সন্ত্রাস, জরিমানা। বহু মানুষ ঘরছাড়া।

বিকেল ৫টা নাগাদ বইচগাছা গ্রামে যখন পৌঁছেছেন বিমানবাবুরা, আকাশ কালো করে মেঘ ঘনিয়েছে। হঠাত্‌ই শুরু হয় প্রবল তোড়ে বৃষ্টি। সঙ্গে ঝড়। তার মধ্যেই ভিজতে ভিজতে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন বর্ষীয়ান ফ্রন্ট চেয়ারম্যান। লোকজন জড়ো হয়েছিল আগে থেকেই। বাকি নেতারাও নেমে পড়েন গাড়ি থেকে। গ্রামের লোকজন বলেন, সিপিএম পরিবারের বহু পুরুষ সদস্য আতঙ্কে রাতে বাড়িতে থাকতে পারছেন না। মাঠের মধ্যে ক্যাম্প করে এক সঙ্গে থাকছেন সকলে। পুলিশ কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না।

বৃষ্টির মধ্যে এখানে বেশি ক্ষণ কথা বলতে পারেননি বাম নেতৃত্ব। গোটা ২০ গাড়ির কনভয় রওনা দেয় বারাসতের দিকে। কিন্তু যাবেন কী করে? কিছু দূর এগোতেই দেখা যায়, রাস্তায় গাছ উল্টে পড়ে আছে। পুলিশ ও গ্রামবাসীদের সাহায্যে সেই গাছ কেটে সরানো হয়। এগোয় কনভয়। আবার একটু দূরে যেতেই একই ঘটনা। রাস্তা জুড়ে উল্টে পড়ে আছে গাছ। বিদ্যুতের ছেঁড়া তার রাস্তার উপরে। সে সবও সরান গ্রামের মানুষ। আবার এগোয় গাড়ি। এ বার রাস্তা জুড়ে বিশাল যে গাছ পড়েছিল, তা সঙ্গে সঙ্গে কেটে সরানোর মতো ছিল না। গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে উল্টো দিকে রওনা দেন বাম নেতৃত্ব। বইচগাছা থেকে নীলগঞ্জ হয়ে বারাসত রোড ধরেন তাঁরা। পরে ফেরে কলকাতার দিকে।

বিমানবাবু বলেন, “এখানে সন্ত্রাস চলছে। মানুষ আতঙ্কিত। সব জানাবো। আমরা মানুষের পাশে আছি, সেই ভরসা দিতেই এসেছিলাম।”

পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, জেলা পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী সে প্রসঙ্গে বলেন, “আমডাঙায় রাজনৈতিক দলগুলি অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ করছে। দু’পক্ষের লোকই গ্রেফতার হচ্ছে। যারা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করতে চাইছে, তাদেরই ধরা হচ্ছে।”

ক’দিন আগেই নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে রাজ্যের বাম কর্মী-সমর্থকদের উপরে লাগাতার সন্ত্রাস চলছে বলে অভিযোগ জানিয়ে এসেছিলেন বিমানবাবুরা। আমডাঙা প্রসঙ্গে তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা কোথাও কোনও হামলা চালাচ্ছে না। কোনও কোনও দলের নিজস্ব দ্বন্দ্বেই এমন ঘটনা।” পুলিশ পুলিশের মতোই কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন