সংসদে তাঁদের হয়ে মুখ খুলবে কে, প্রশ্ন শেওড়াফুলির যৌনকর্মীদের

ভোটের দিন ঘোষণা হওয়া ইস্তক ওঁরা ছুটে বেড়াচ্ছেন এ দল, সে দলের প্রার্থীদের কাছে। আর্জি একটাই মানুষের রায়ে সাংসদ হলে ওঁদের জন্য যেন একটু গলা তোলেন। কিন্তু সেই কথা কেউ শুনলে তো! ওঁরা শেওড়াফুলির গড়বাগানের যৌনকর্মী। স্বীকৃতির দাবিতে আজও চলছে যাঁদের দীর্ঘ লড়াই।

Advertisement

প্রকাশ পাল

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৩০
Share:

ভোটের দিন ঘোষণা হওয়া ইস্তক ওঁরা ছুটে বেড়াচ্ছেন এ দল, সে দলের প্রার্থীদের কাছে। আর্জি একটাই মানুষের রায়ে সাংসদ হলে ওঁদের জন্য যেন একটু গলা তোলেন। কিন্তু সেই কথা কেউ শুনলে তো! ওঁরা শেওড়াফুলির গড়বাগানের যৌনকর্মী। স্বীকৃতির দাবিতে আজও চলছে যাঁদের দীর্ঘ লড়াই।

Advertisement

গড়বাগানের পঞ্চাশটিরও বেশি বাড়িকে নিয়ে এই যৌনপল্লি বহু বছরের পুরনো। বর্তমানে এখানে প্রায় এক হাজার যৌনকর্মী আছেন। ওঁদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের জন্য আছে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি। কমিটির বক্তব্য, সরকারের শ্রম মন্ত্রকে যে কাজের তালিকা আছে, সেখানে যৌনপেশাও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যৌনকর্মীদের স্বশাসিত বোর্ডকেও সরকারি স্বীকৃতি দিতে হবে। পাশাপাশি ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার যে ‘ইটপা’ আইন (ইমমরাল ট্র্যাফিক প্রিভেনশন অ্যাক্ট) প্রণয়ন করে, তার বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করতে হবে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক যৌনকর্মী বলেন, ‘‘প্রতি বারই ভোট এলে আমরা প্রার্থীদের কাছে ছুটে যাই। কিন্তু সংসদে আমাদের দাবি-দাওয়ার কথা কেউ তোলে না। সৎপথে রোজগার করি আমরা। কিন্তু শ্রমিকের তকমা নেই।” ওই যৌনকর্মীর আক্ষেপ, ‘‘সকলের কাছেই সময় চাইছি। কিন্তু দেখা করার সুযোগই পাচ্ছি না।”

দুর্বারের দাবি, এইচ আই ভি নিয়ন্ত্রণে সচেতনা মূলক নানা কর্মসূচি করে তাঁরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) তাঁদের প্রকল্পকে ‘মডেল প্রকল্পে’র স্বীকৃতি দিয়েছে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির রাজ্যের সচিব ভারতী দে মনে করেন, তাঁদের স্বশাসিত বোর্ড সরকারি স্বীকৃতি পেলে আরও ভাল করে কাজ করতে পারবে। তাতে যৌনকর্মীরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবেন। যৌনকর্মীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, গত এক দশকে তাঁদের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই। আগে এখানকার ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হত। মণি সাহা নামে দীর্ঘ দিনের এক যৌনকর্মী জানালেন, বহু ক্ষেত্রেই পিতৃপরিচয় না-থাকায় স্কুল বাচ্চাদের ভর্তি নিতে চাইত না। এখন অবশ্য শুধু মায়ের পরিচয়েই সন্তানেরা স্কুলে ভর্তি হতে পারছে। গড়বাগানের অন্তত সত্তর জন শিশু, কিশোর-কিশোরী ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায়। তাদের অনেকেই স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল, অনেকে আবার পরিবারের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। আইসিডিএস সেক্টর-এর শঙ্করী দাস, মিনতি ঘোষেরা জানালেন, আগে এখানকার বাসিন্দাদের রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড করাতে কালঘাম ছুটে যেত। পাঁচ বছর আগে কংগ্রেসের নেতা তথা প্রাক্তন কাউন্সিলর অমিয় মুখোপাধ্যায়ের মধ্যস্থতায় ১১৮ জনের রেশন কার্ড হয়। গত বছর ২২ জন যৌনকর্মী আর তাঁদের তিন জন সন্তানের ভোটার কার্ড হয়েছে। যৌনকর্মীদের কথায়, “আগে সমাজ আমাদের একেবারেই অচ্ছুৎ করে রাখত। এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। তৃতীয় শ্রেণির একটি শিশু কয়েক দিন স্কুলে যেতে পারেনি বলে প্রধান শিক্ষক নিজে খোঁজ নিতে এসেছিলেন।” এই সহমর্মিতাটুকুতেই কত খুশি সকলে! আগে যখন তখন পুলিশ অত্যাচার করত বলে যৌনকর্মীদের অভিযোগ ছিল। গত কয়েক বছরে সেই সমস্যাও কমেছে বলে জানালেন অনেকেই। উল্টে দুর্গাপুজোয় বস্ত্র বিতরণ-সহ নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে পুলিশের উদ্যোগে। বিদায়ী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছর কম্পিউটার দিয়েছেন যৌনকর্মীর সন্তানদের শিক্ষার জন্য। বিধায়ক থাকাকালীন আব্দুল মান্নানও অর্থসাহায্য করেছিলেন দুর্র্বারের ভবন তৈরির জন্য।

Advertisement

যৌনকর্মীরা বলছেন, গত কয়েক বছরে জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের আপদে-বিপদে এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন। এ বার সাংসদদের কাছে তাঁদের আর্জি দিল্লিতে গিয়ে তাঁরা একটু গলা তুলুন। শ্রমিকের তকমাটা অন্তত এ বার জুটুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন