ডুবে যাওয়ার খবর পেলেই ঝাঁপ দেন তিনি

ভোর কিংবা গভীর রাত, কেউ জলে ডুবলেই ডাক পড়ে তাঁর। মোবাইলে খবর পেলে তিনিও সময় নষ্ট না করে পিঠে ছোট একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে মোটরবাইক নিয়ে সোজা হাজির হন দুর্ঘটনাস্থলে। শর্টস পরে, চোখে সাঁতারের চশমা এঁটে ঝাঁপ দেন জলে— তা সে গঙ্গাই হোক বা কোনও পুকুর। জলে ডুব দিয়ে তুলে আনেন দেহ।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

হাওড়া শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:২৪
Share:

বীরেন কর্মকার। — নিজস্ব চিত্র

ভোর কিংবা গভীর রাত, কেউ জলে ডুবলেই ডাক পড়ে তাঁর। মোবাইলে খবর পেলে তিনিও সময় নষ্ট না করে পিঠে ছোট একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে মোটরবাইক নিয়ে সোজা হাজির হন দুর্ঘটনাস্থলে। শর্টস পরে, চোখে সাঁতারের চশমা এঁটে ঝাঁপ দেন জলে— তা সে গঙ্গাই হোক বা কোনও পুকুর। জলে ডুব দিয়ে তুলে আনেন দেহ। তিনি বেলুড়ের বীরেন ডুবুরি।

Advertisement

বেলুড়ের অম্বিকা জুটমিলের অস্থায়ী ‘গেট বাবু’ এই বীরেন কর্মকার এখনও পর্যন্ত জল থেকে উদ্ধার করেছেন ৭৩ জনকে। এঁদের মধ্যে কয়েক জন তো বেলুড়ের ৪৬ বছরের এই ডুবুরির হাত ধরে ফিরে এসেছেন মৃত্যুমুখ থেকে। বালি-বেলুড়-লিলুয়ার গণ্ডী পেরিয়ে তাই বীরেন ডুবুরির ডাক পড়ে অন্য জেলাতেও। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, ডাক আসে পুলিশের কাছ থেকেও— বলছিলেন বীরেন। তাঁর দাবি, ‘‘অনেক সময়েই হয়েছে যে, পুলিশের ডুবুরি আসতে দেরি করছে কিংবা জলে নেমেও কিছু করতে পারেনি। কিন্তু আমি জলে ডুব দিয়ে দেহ তুলে নিয়ে এসেছি।’’

প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ ভাবেই শখের ডুবুরির কাজ করছেন বীরেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে গঙ্গায় এক বৃদ্ধাকে ভেসে যেতে দেখে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন তাঁকে। তার পর থেকেই জলের নীচে গিয়ে ডুবন্ত মানুষকে খোঁজার কাজে হাত পাকাতে শুরু করেন। সেই কাজেই এখন তিনি পুরোমাত্রায় দক্ষ। দাশনগর সিটিআই থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলেও ভাল চাকরির সুযোগ ছেড়ে বেলুড়েই থেকে গিয়েছেন তিনি। পেশা বলতে জুটমিলের চাকরি। আর এর পাশাপাশিই বিনা পারিশ্রমিকে জলে ঝাঁপিয়ে মানুষকে উদ্ধার করতে ভালবাসেন বেলুড়ের এই বীরেন ডুবুরি। তাঁর কথায়, ‘‘টাকা নেব কেন? মানুষকে উদ্ধারের জন্য সকলের যে আশীর্বাদ পাই, তা-ই যথেষ্ট।’’

Advertisement

বালি, বেলুড় ছাড়াও ডোমজুড়, নদিয়া, কোন্নগর, উত্তরপাড়া, কাশীপুর— সব জায়গাতেই সকলে এক ডাকে চেনেন বীরেন ডুবুরিকে। পুকুর, ঝিল, গঙ্গা কিংবা নদীর ঘূর্ণি থেকে একের পর এক উদ্ধারের কাজ করেছেন তিনি। বছর তিনেক আগে, নদিয়ার ঘোষপাড়ার কাছে চরসরায় পাড়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময়ে গঙ্গায় পড়ে তলিয়ে যান এক যুবক। ভাঙন প্রবণ ওই এলাকায় ঘূর্ণি থাকায় সারা রাত খোঁজ করেও দেহ পায়নি পুলিশ। পরের দিন বীরেন কিন্তু সেখানে গিয়ে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় ওই যুবকের দেহ তুলে আনেন।

কিন্তু অক্সিজেন বা আধুনিক সর়়ঞ্জাম ছাড়া জলে নামার ক্ষেত্রে তো বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। বীরেন অবশ্য বললেন, ‘‘এই কাজের জন্য শরীরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। নিয়মিত অভ্যাস করতে হয় যোগ ব্যায়াম ও গুরুমুখী ক্রিয়া। প্রতিদিন সকালে প্রাণায়াম ও যোগাভ্যাস করে তবেই গঙ্গায় স্নান করতে যাই।’’ তবে অক্সিজেন ও আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি পেলে কাজের সুবিধা হত বলে মত বেলুড়ের এই ডুবুরির।

বীরেন ডুবুরিকে তাঁর কাজের জন্য সম্মানিতও করেছে রাজ্য যুব কল্যাণ বিভাগ ও হাওড়া সিটি পুলিশ। বীরেন কিন্তু চান, তাঁর পরেও কেউ এই কাজ করুক। বললেন, ‘‘কয়েক জন যুবককে প্রশিক্ষণ দিতে পারি, যাতে আগামী দিনে ওঁরা এই কাজ করতে পারেন।’’ কিন্তু সামর্থ্যের অভাবেই সে কাজ হয়ে ওঠে না বলে জানালেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, ‘‘বিষয়টি প্রথম জানলাম। খুব ভাল কাজ করছেন বীরেন। আমাদের দফতরের তরফে তাঁকে কিছু সহযোগিতা করা যায় কি না, দেখছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন