নিয়মের ফাঁসটা রাজ্য সরকার বাঁধতে চেয়েছিল ডাক্তারদের গলায়। কিন্তু সেই ফাঁস যে শেষ পর্যন্ত তাঁদের নিজেদেরই দমবন্ধের কারণ হবে, তা ভাবতেও পারেননি স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা।
কীসের ফাঁস?
এ রাজ্যে এখন স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার সুযোগ পেতে গেলে তিন বছরের জন্য বন্ড সই করতে হয় ডাক্তারদের। পাশ করার পরে জেলায় গিয়ে তিন বছর কাজ করার মুচলেকা দিতে হয়। বন্ড ভাঙলে ৩০ লক্ষ টাকার জরিমানা ধার্য হবে। উদ্দেশ্য একটাই, জেলার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো।
কিন্তু ডাক্তারদের একটা বড় অংশ জানিয়ে দিয়েছেন, এ ভাবে দাসখত লিখে কাজ করতে তাঁরা পারবেন না। আর তাই ডিএম, এমসিএইচ-এ ভর্তি হওয়ার প্রবেশিকা পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হু হু করে কমছে। এমনকী ভিন্ রাজ্য থেকে যে ছাত্রেরা স্নাতকোত্তর স্তরে এখানে ডাক্তারি পড়তে আসেন, আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তাঁরাও। সব মিলিয়ে রাজ্যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের খরা কাটার কোনও সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, অন্য বার ডিএম, এমসিএইচ-এ ভর্তির জন্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যাটা দু’হাজার ছাড়িয়ে যায়। রাজ্য সরকার শর্ত চাপানোয় গত বছর থেকেই তা কমতে শুরু করেছিল। গত বার ছিল ১২০০। আর এ বার সংখ্যাটা ৭০০-ও ছাড়ায়নি। এমডি এবং এমএস পাশ করার পরে অর্থাৎ পোস্ট ডক্টরাল স্তরে মেডিসিনের ক্ষেত্রে ডিএম এবং সার্জারির ক্ষেত্রে এমসিএইচ পড়া যায়। দেশের অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এই দুটি ক্ষেত্রেই আসন বেশি। কিন্তু রাজ্যের ডাক্তারেরা অনেকেই শর্তাধীনে এখানে পড়ার ক্ষেত্রে গররাজি হওয়ায় স্বাস্থ্য ভবনের কপালে ভাঁজ।
চিকিৎসকদের অনেকেই দলবদ্ধ ভাবে স্বাস্থ্য ভবন এবং স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ৩০ লক্ষ টাকা জরিমানা জারির বিষয়ে তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় বার সরকার গঠনের পরে সেই চিকিৎসকেরা অনেকেই এ বার সরাসরি তাঁর কাছে আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, ৩০ লক্ষ টাকার ওই বন্ডের অঙ্ক নজিরবিহীন। গুজরাত, রাজস্থান, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র-সহ আরও কয়েকটি রাজ্যেও এই ধরনের বন্ড চালু হয়েছে। কিন্তু কোথাওই অঙ্কটা এত বেশি নয়।
আগে এ রাজ্যে এই বন্ড ছিল এক বছরের। টাকার অঙ্কটা ছিল ১০ লক্ষ। আপত্তি তখনও উঠেছিল। কিন্তু তা এত প্রবল হয়নি। তিন বছরের বন্ড ডাক্তারদের একটা বড় অংশকেই বিদ্রোহী করে তুলেছে।
এ রাজ্য থেকে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়া এক ডাক্তারের কথায়, ‘‘এই নিয়ম চালুর আগে সরকারের উচিত ছিল বেতন কাঠামো সংশোধন করা। তিন বছর বেঁধে রাখার জন্য যে পরিমাণ টাকা দেওয়া দরকার, সরকার তা দেয় না। আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় ডাক্তারদের। এর চেয়ে বরং তাঁরা অন্য রাজ্য থেকে পাশ করে এসে বেসরকারি হাসপাতালে যোগ দেবেন। তাতে তাঁদের সব দিক থেকেই মঙ্গল।’’
ক্ষমতায় এসে তৃণমূল সরকারের ঘোষণা ছিল, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় মোট ৪১টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল খোলা হবে। পাঁচ বছরের মাথায় কাগজে-কলমে ২১টি হাসপাতাল হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১৪টিতে আউটডোর পরিষেবা চালু হয়েছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে একই দিনে তড়িঘড়ি আরও যে সাতটি হাসপাতালের উদ্বোধন হয়েছিল, সে গুলিও কার্যত না হওয়ারই মতো। কোথাও শুধু চোখের ডাক্তার আসেন। কোথাও বা শুধু নাক-কান-গলার ডাক্তার। আবার কোথাও সপ্তাহে মাত্র দু’দিন এক জন মেডিসিনের ডাক্তার ঘর আগলে বসে থাকেন। যত দিন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়বে, তত দিন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, প্রতি বছর যত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাশ করে বেরোন, তাঁদের একটা বড় অংশই অন্য রাজ্যের পড়ুয়া। তাঁরা পাশ করে নিজেদের রাজ্যে ফিরে যান। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘নিউরো সার্জারি, কার্ডিওথোরাসিকের মতো বিষয়ের প্রবেশিকায় এ রাজ্যের চেয়ে অন্য রাজ্যের ছেলেমেয়েরাই বেশি উত্তীর্ণ হন। তার পরে এ রাজ্যের যাঁরা থাকেন, তাঁদেরও অনেকে জেলায় যেতে চান না। ফলে রাজ্যের ভাগ্যে জোটে লবডঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে তিন বছরের সুপার স্পেশ্যালিটি বন্ড চালু করে কোনও মতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তাতে যে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে, তা ভাবা যায়নি।’’
চিকিৎসক সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য শাখার সম্পাদক তথা তৃণমূল নেতা শান্তনু সেন অবশ্য এ ক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নতুন, নতুন মেডিক্যাল কলেজ খোলা হচ্ছে। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল খোলা হচ্ছে। সেখানে ডাক্তার পাওয়া যাবে কোথা থেকে? সরকারি মেডিক্যাল কলেজে যাঁরা পড়ছেন, সরকারের প্রতি এটুকু দায়বদ্ধতা তাঁদের থাকতেই হবে।’’