দরকার ছিল পাঁচ বোতল রক্তের। কিন্তু মেরেকেটে জোগাড় করা গিয়েছিল মাত্র এক বোতল! রক্তের জোগানের ঘাটতি নিয়েই দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হওয়া যুবকের অস্ত্রোপচার করেছিলেন দুই চিকিৎসক। অস্ত্রোপচারের দু’দিন পরে সংক্রমণের জেরে মারা যান ওই যুবক। তা নিয়ে পুলিশে অভিযোগ জানায় রোগীর পরিবার। ওই চিকিৎসকদের এক জন জানান, তখনও অ্যাপোলো কাণ্ড ঘটেনি। তাতেই যারপরনাই হেনস্থা হতে হয়েছিল। অ্যাপোলো কাণ্ডের পর তাঁর মন্তব্য, ‘‘এখন যা অবস্থা তাতে ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্রোপচার করবই না।’’
সম্প্রতি বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও একাধিক অভিযোগ উঠছে। নানা ভাবে হেনস্থার শিকারও হতে হচ্ছে তাঁদের। এই পরিস্থিতিতে কিছুটা সিঁটিয়ে গিয়েছেন ডাক্তারেরা। তাঁদের অনেকেই বলছেন, পেশায় ঝুঁকি নিতে গিয়ে এখন দশ বার ভাবছেন। এবং এই সাবধানী মনোভাবের খেসারত দিতে হবে রোগীদেরই। অনেক চিকিৎসকই ইতিমধ্যেই জটিল অস্ত্রোপচারের তারিখ পিছিয়ে দিয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে বিলেতের এক নামী শল্য চিকিৎসকের কথাও প্রচারিত হচ্ছে। আজীবন একাধিক অস্ত্রোপচার করে সামান্য ভুলের জন্য তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল! ‘‘বিদেশে এই সমস্যা আগেই শুরু হয়েছিল। এ বার এখানেও জল সে দিকেই গড়াচ্ছে,’’ বলছেন দীর্ঘদিন বিলেতে কাটানো এক বাঙালি সার্জেন।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, হৃদরোগ, জটিল সংক্রমণের চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকেই যায়। অনেক সময়ই কয়েক মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয় চিকিৎসককে। কিন্তু আইনি জটিলতা এড়াতে চিকিৎসক যদি দোনোমনা করেন তা হলে যথাযথ চিকিৎসা না-ও মিলতে পারে। ‘‘এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের মানসিক চাপমুক্ত থাকাটা জরুরি। কিন্তু এখন ডাক্তারেরা চাপমুক্ত হয়ে চিকিৎসা করতে পারছেন না,’’ মন্তব্য এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের।
এই পরিস্থিতিতে সঙ্কটে পড়েছেন তরুণ চিকিৎসকদের অনেকেই। সদ্য স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করা এক চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘আমাদের অভিজ্ঞতা কম, নামযশও কম। ফলে ভুল হলে সহজেই ভিলেন বানিয়ে দেওয়া যাবে। ক্ষতি হবে কেরিয়ারের।’’ সোশ্যাল মিডিয়ায় বেঙ্গালুরুর এক ডাক্তারি পড়ুয়ার কথা ঘুরে বে়ড়াচ্ছে। এমবিবিএস-এ ফার্স্ট হয়েও তিনি মেডিসিন, সার্জারি, গাইনির মতো ক্লিনিক্যাল বিষয়ের বদলে প্যাথলজি নিয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হবেন বলে জানিয়েছেন। শহরের এক চিকিৎসক দম্পতির ছেলেও ডাক্তার হবে বলেই ঠিক করেছিল। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির পরে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া অবশ্য বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছে, সে ডাক্তারি প্রবেশিকার পরীক্ষাতে বসবে না।
শহরের এক নামী ইউরোলজিস্টের মতে, চিকিৎসা অনেকটাই নির্ভর করে রোগী ও ডাক্তারের পারস্পরিক বিশ্বাসের উপরে। কিন্তু গত ক’দিনে সেই বিশ্বাসের ভিত যেন নড়ে গিয়েছে। ‘‘এই সমস্যা না কাটলে আগামী দিনে কিন্তু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তার হাত থেকে ডাক্তার বা রোগী—কেউই বাদ পড়বে না,’’ মন্তব্য ওই চিকিৎসকের।