গভীর রাতে স্বাস্থ্যদীপে তখন চলছে আলট্রাসনোগ্রাফি। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
কোথাও আইনের দোহাই দিয়ে প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি। কোথাও আবার শীতরাতে তরুণীর প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া লড়াই, তা-ও আবার নিয়মের লক্ষ্মণরেখার তোয়াক্কা না করেই!
দু’দিন আগেই শ্রীরামপুরে ট্রেনের ধাক্কায় মৃতপ্রায় যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে না পাঠিয়ে কর্তব্যরত জিআরপি কর্মীরা অপেক্ষা করেছিলেন রেলের ‘মেমো’ আসার জন্য। চোখের সামনে সে দৃশ্য আর সহ্য করতে না পেরে আশপাশ থেকে দু’চারজনকে জুটিয়ে আহত যুবককে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন রেলযাত্রী এক তরুণী। যুবকটিকে বাঁচানো যায়নি। কিন্তু ওই তরুণী এই প্রশ্নটা তুলে দিয়েছেন, আইন আগে না প্রাণ। শনিবার গভীর রাতে বনগাঁর জখম তরুণীকে বাঁচাতে যে উদ্যোগ দেখালেন পুরপ্রধান, তাতে যেন উত্তর মিলল সেই প্রশ্নেরই।
কী হয়েছিল শনিবার?
দুষ্কৃতীর ধারাল অস্ত্রের কোপে জখম হয়েছিলেন রেবা মালাকার আর তাঁর বাবা ভোলানাথবাবু। রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁদের পড়ে থাকতে দেখে প্রতিবেশী, আত্মীয়েরা দু’জনকে উদ্ধার করে নিয়ে যান বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা তৎক্ষণাৎ তরুণীকে ‘রেফার’ করেন কলকাতার হাসপাতালে। ভোলানাথবাবুকে অবশ্য ভর্তি নেওয়া হয় হাসপাতালে।
কোনও সূত্র মারফত খবর পৌঁছয় বনগাঁর পুরপ্রধান শঙ্কর মালাকারের কাছে। তিনি এসে হাজির হন হাসপাতালে। চিকিৎসকের কাছে জানতে চান, কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তর না করালেই কি নয়?
চিকিৎসকেরা বুঝিয়ে বলেন, আঘাত গুরুতর। যকৃত বা ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। সেটা জানা না গেলে চিকিৎসা করে লাভ নেই। কিন্তু জানার উপায় কী? অবশ্যই এক্স-রে এবং আলট্রাসনোগ্রাফি। কিন্তু অত রাতে হাসপাতালে যা সম্ভব নয়। শহরের অন্যত্রও কোথাও কিছু খোলা নেই।
রাত তখন প্রায় ১টা। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুরপ্রধানের কপালে চিন্তার ভাঁজ। মুহূর্ত ভেবে তিনি জানতে চান, ‘‘আলট্রাসনোগ্রাফি, এক্স রে করলে কী এখানে চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন?’’ কর্তব্যরত চিকিৎসক স্বাগত দাসের গলায় ফিরে আসে আত্মবিশ্বাস, উত্তর মেলে, ‘‘অন্তত চেষ্টা করা দেখতে পারি।’’
পুরপ্রধান আর সময় নষ্ট না করে খবর পাঠান পুরসভার স্বাস্থ্যদীপের কর্মীদের। সেখানকার কর্মীরা সকলেই স্থানীয় বাসিন্দা। পুরপ্রধানের নির্দেশ পেয়ে তড়িঘড়ি মাঙ্কি ক্যাপ, চাদর জড়িয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির স্বাস্থ্যদীপে। খোলা হয় গেটের তালা। আলট্রাসনোগ্রাফি, এক্স-রে-র ঘর। সব মিলিয়ে সময় কেটে যায় আরও মিনিট কুড়ি।
বাকি কাজ দ্রুত হাতে সারেন কর্মীরা। রেবার আলট্রাসনোগ্রাফি আর এক্স রে রিপোর্ট নিয়ে বাইক ছোটে হাসপাতালে। স্বাগতবাবু দেখেন, যকৃত বা ফুসফুসে চোট লাগেনি। হাসপাতালের এইচডিইউ ইউনিটে ভর্তি নেওয়া হয় রেবাকে। সোমবার সকালে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
রেবার মা রিনাদেবী বলেন, ‘‘অত রাতে কলকাতায় মেয়েকে নিয়ে যেতে আর্থিক সমস্যা তো হতই। তা ছাড়া, অতটা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে আরও কত ক্ষতি হত কে জানে! তার উপরে স্বামীও তো জখম। কাকে ছেড়ে কাকে দেখতাম।’’ রিনাদেবীর কথায়, ‘‘আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে পুরপ্রধান যা করলেন, তা বহু মানুষ মনে রাখবে।’’
কিন্তু কেন হামলা হল বাবা-মেয়ের উপরে?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বনগাঁ শহরের জয়পুর এলাকার বাসিন্দা ভোলানাথবাবু শনিবার রাতে মেয়েকে স্টেশন থেকে নিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। রেবা সল্টলেকের সেক্টর-৫ এলাকায় একটি ব্যাঙ্কে কাজ করেন। রাত ৯টা নাগাদ ভোলানাথবাবু যখন বাইক নিয়ে এলাকার রাস্তায় ঢুকেছেন, তখন হঠাৎই ধারাল অস্ত্র দিয়ে তাঁর কপাল ও মাথা লক্ষ করে কোপ মারে দুষ্কৃতী। তিনি বাইক নিয়ে পড়ে যান। মেয়েও পড়ে যায়। তাঁকেও ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। চিৎকার শুনে এলাকার লোকজন ছুটে এলে দুষ্কৃতী ছুটে পালিয়ে যায়।
এই ঘটনায় রিনাদেবী বনগাঁ থানায় জামাই গোপাল দাসের নামে খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেছেন। গোপাল পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার খোঁজ চলছে। বছর চারেক আগে এলাকারই বাসিন্দা গোপালের সঙ্গে রেবার বিয়ে হয়। তাদের দেড় বছরের একটি শিশুপুত্রও রয়েছে। অভিযোগ, গোপাল নেশাসক্ত। স্ত্রীর উপরে অত্যাচার করে। এই পরিস্থিতিতে বেরাদেবী বছর দু’য়েক হল স্বামীকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। পরিবারের দাবি, সেই আক্রোশেই হামলা চালিয়েছে গোপাল।
পুলিশ তদন্ত করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। তার আগেই পুরসভা অবশ্য একটি জরুরি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। শঙ্করবাবু জানান, এখন থেকে রাতেও পুরসভার স্বাস্থ্যদীপ খুলে রাখা হবে। জরুরি প্রয়োজনে পরিষেবা মিলবে।’’
কিন্তু শনিবার যে বিরল ঘটনার সাক্ষী থাকল বনগাঁ, তা নিয়ে কী বলছেন শঙ্করবাবু? তাঁর কথায়, ‘‘বনগাঁ থেকে কলকাতায় রোগী নিয়ে যাওয়াটা সত্যিই বড় সমস্যার। যে কোনও বিপদ-আপদ হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ মাথায় এল, একটা চেষ্টা করেই দেখা যাক না!’’
আইনের গেরোয় বাঁধা পড়ে না থেকে এমন চেষ্টাটুকুই বাঁচাতে পারে বহু প্রাণ।