বিধির তোয়াক্কা না-করে শব ফেলে রাখা হয় এ ভাবেই।
মৃত্যুতেও মানুষের বৃহত্তর কল্যাণকাজে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন মা। যাঁরা মানুষের নানান ব্যাধির আরোগ্য সন্ধান করেন, সেই চিকিৎসক, হবু চিকিৎসকদের অনুশীলনের কাজে নিজের নশ্বর দেহ দানের অঙ্গীকার করে গিয়েছিলেন মা।
কিন্তু মায়ের শেষ ইচ্ছার মূল্য যে এ ভাবে চোকাতে হবে, তা ভাবতে পারেননি স্বর্ণেন্দু সরকার।
গর্ভধারিণীর অঙ্গীকার অনুসারে সম্প্রতি কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজে মায়ের মরদেহ পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন কেশব সেন স্ট্রিটের স্বর্ণেন্দু সরকার। দানের কাজ সম্পন্ন করতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। সান্ত্বনা ছিল, মায়ের অনুজ্ঞা মেনে তাঁর দেহ ঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পেরেছেন।
কিন্তু একটু পরেই চোখ কপালে উঠল স্বর্ণেন্দুবাবুর। না বরফ-ঘর, না কোনও রকম রাসায়নিক। না ফর্মালিন ইঞ্জেকশন, না ফর্মালিন ভ্যাট (শব সংরক্ষণের রাসায়নিক এবং আধার)। দেখলেন, সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা না-করেই অ্যানাটমি বিভাগের টেবিলে মায়ের মরদেহ নিতান্ত হেলাফেলায় ফেলে রেখে ওই মেডিক্যালের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী ওই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন!
দানের দেহের এ-হেন অমানবিক অবহেলার ধাক্কায় সারা রাত ছটফট করেছেন স্বর্ণেন্দুবাবু। পরের দিন সকালে গিয়ে মায়ের দেহ কী অবস্থায় দেখবেন, সেই চিন্তা তাঁকে ঘুমোতে দেয়নি। তাঁর আত্মীয়বন্ধু-পরিজনদের অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, হাসপাতালের বদ্ধ ঘরে এ ভাবে পড়ে থাকা একটা মৃতদেহ পেয়ে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে না মূষিককুল!
পরের দিন সাতসকালে হাসপাতালের সেই বন্ধ ঘরের সামনে পৌঁছে অপেক্ষা করছিলেন মা-হারানো ওই অধ্যাপক। ঘরের দরজা এক সময় খুলল। মায়ের দেহটি দেখে আঁতকে উঠলেন স্বর্ণেন্দুবাবু। দেখলেন, মায়ের মরদেহে পচন ধরে গিয়েছে। আর কেউ যেন খুবলে তুলে নিয়েছে ডান পায়ের একটি আঙুল। কাউকে কিছু না-বলে ফিরে এসেছিলেন বাড়িতে। আর তার পরেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে মনোবেদনার কথা জানিয়ে ওই অধ্যাপক লিখেছেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের চর্চায় সাহায্য করার জন্য যাঁরা নিজেদের প্রিয়জনের দেহ দান করেন, এই দৃশ্য তাঁদের কতটা আহত করে, সেই ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্তাদের কি কোনও ধারণা আছে? যেখানে সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রোগীদের ইঁদুরে কামড়ানোর অভিযোগ ভূরি ভূরি, সেখানে সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না-করে একটি মৃতদেহ এ ভাবে ফেলে রেখে দেওয়া কি আদতে দেহদান আন্দোলনকেই অসম্মান করা নয়?’
চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল স্বাস্থ্য ভবনের ঠিকানায়। চিঠি পেয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা আদৌ বিস্মিত হননি। কারণ, দেহদানের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে স্বাস্থ্যকর্মীদের যে সদিচ্ছা নেই, সেটা তাঁদের অজানা নয়। জানা আছে পরিকাঠামোর অভাবের কথাও। আর এর জন্য যে দেহদানের আন্দোলনই মার খাচ্ছে, তা তাঁরা অস্বীকার করছেন না। পত্রলেখক অধ্যাপককে সহানুভূতি জানানো ছাড়া তাঁদের যে আর কিছু করার নেই, স্বাস্থ্যকর্তারা সেটাও কবুল করছেন।
ওই চিঠি যে আদতে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড়সড় এক অব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলেছে, তা অস্বীকার করছেন না স্বাস্থ্যকর্তাদের অনেকেই। তাঁরা বলছেন, শুধু কলকাতার ওই হাসপাতাল নয়, রাজ্যের বেশির ভাগ মেডিক্যাল কলেজেই দেহদান পরিস্থিতির এমনই দুরবস্থা। জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে মৃতদেহ নেওয়া হয় না বললেই চলে। কলকাতাতেও বিকেলের পরে দানের দেহ নেওয়া কার্যত বন্ধ। যদি দায়ে পড়ে নিতে হয়, সে-ক্ষেত্রেও দেহটিকে ইঁদুরবাহিনী ও পোকামাকড়ের মুখে ফেলে রেখে চলে যান কর্মীরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেহ পচে যায়। কখনও বা ইঁদুর বা পোকামাকড় খুবলে নেয় নানান প্রত্যঙ্গ।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে পত্রলেখক লিখছেন, ‘কলকাতার অন্যতম প্রধান এক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মায়ের দেহ পৌঁছে দিতে বিকেল গড়িয়ে গিয়েছিল। যথারীতি দেহটি গ্রহণ করার মতো কেউ ছিলেন না সেখানে। বলে দেওয়া হয়েছিল, ‘পরের দিন আসুন’। পরিচিতি কাজে লাগিয়ে সেই বিকেলেই দেহটি গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে রাজি করাতে পেরেছিলাম। তার পরে যে এমনটা ঘটবে, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।’
কী ঘটেছিল তার পরে?
পত্রলেখকের অভিযোগ, ‘দীর্ঘ ক্ষণ অপেক্ষার পরে চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী অ্যানাটমি (অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিদ্যা) বিভাগের একটি ঘরের তালা খুলে টেবিলে দেহটি রেখে ফের ঘর বন্ধ করে দিলেন। আমরা বললাম, ‘সকালে মৃত্যু হয়েছে। এখন সন্ধ্যা। যে-কোনও সময়েই দেহে পচন ধরতে শুরু করবে। যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না-করে সেটি কি এ ভাবেই ফেলে রাখা হবে?’ ওই কর্মী জানিয়ে দিলেন, বাকি যা করার, তা পরের দিন সকাল ১০টার পরে ডাক্তার আর অন্য কর্মীরা এসে করবেন। বিকেলের পরে এলে এটাই দস্তুর।’’
রাজ্যে দেহদানের প্রক্রিয়াটাই কি এতে ব্যাহত হচ্ছে না?
পশ্চিমবঙ্গে দেহদান আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন, সমাজকর্মী ব্রজ রায় তাঁদের অন্যতম। তিনি বলেন, ‘‘এমন ঘটনা দেহদান আন্দোলনকে জোর ধাক্কা দেয়। সাধারণ ভাবে মৃতদেহে ফর্মালিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার কাজটা চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাই করেন। সমস্যা হল, তাঁদের বহু পদ খালি। যেখানে ১০ জন থাকার কথা, সেখানে রয়েছেন হয়তো তিন জন। তাই বেশির ভাগ জায়গাতেই চূ়ড়ান্ত অব্যবস্থা।’’
বৈজ্ঞানিক ভাবে সংরক্ষণ না-করে এ ভাবে দেহ ফেলে রাখলে সেটি কি আর কাজে লাগবে?
‘‘ঠিক সময়ে সংরক্ষণ না-করলে দেহে পচন ধরবেই। পচন ধরা শব ঠিকঠাক ব্যবচ্ছেদ করতে পারবে না মেডিক্যাল পড়ুয়ারা। অর্থাৎ দেহদানের মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হবে,’’ বললেন কলকাতারই অন্য একটি মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমির এক অধ্যাপক।
কী ভাবে রাখা উচিত মৃতদেহ?
অ্যানাটমির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সাধারণ ভাবে মৃতদেহ গ্রহণের পরে কুঁচকির কাছে ফর্মালিন ইঞ্জেকশন দেওয়াটাই রীতি। কিন্তু যদি ‘অড আওয়ার’ (অসময়)-এ অর্থাৎ বিকেলের পরে বা রাতবিরেতে দেহ আসে, সে-ক্ষেত্রে কোনও ডাক্তার, টেকনিশিয়ান বা নিদেনপক্ষে কোনও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীকে ওই দেহ ফর্মালিন চেম্বার বা ফর্মালিন ভ্যাটে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। পরের দিন বাকি প্রক্রিয়া শেষ করার কথা শিক্ষক-চিকিৎসকদের।
এটুকুও করা হয় না কেন? কী বলছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা?
স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যা ঘটেছে, সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কর্মী-সমস্যার দোহাই দিয়ে এমন অবহেলা বরদাস্ত করা যায় না। আসল কথা হল সদিচ্ছা। সেটা তো জোর করে আনা সম্ভব নয়। তবু এ ব্যাপারে সব মেডিক্যাল কলেজকেই আবার সতর্ক করে দেবো আমরা।’’
সতর্ক করে দেওয়া হয় বারবার। তবু দানের দেহ বা চোখ-সহ বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ গ্রহণের ক্ষেত্রে ফের ঘটতে থাকে অবহেলা। শুধু আম-আদমি নয়, এই অব্যবস্থা থেকে পার পান না ভিভিআইপি-রাও। যেমন নীলরতন সরকার হাসপাতালে প্রাক্তন মন্ত্রী বিনয় চৌধুরীর চোখ নেওয়া যায়নি। যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ না-করায় তা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলেই অভিযোগ। পরে যুক্তি দেওয়া হয়, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বিনয়বাবুর চোখ ব্যবহারযোগ্য ছিল না। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তাই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মরদেহ নীলরতনে দান না-করে পাঠানো হয় এসএসকেএমে। যে-দিন বসুর দেহ পিজিতে পাঠানো হয়, সে-দিন অন্য কোনও মৃতদেহ নেওয়া হয়নি। ‘ভিভিআইপি-র দেহ’ আসছে, এই অজুহাতে!