Infiltrators Flee Back

দালালকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ঢুকেছিলাম ভারতে, ২০ হাজারে আধার কার্ড, প্যান কার্ড পেয়েছিলাম, এখন পথে বসেছি!

ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘ফ্রম কলকাতা। লিভ্‌স ইন কলকাতা।’ মানে আমি কলকাতার ছেলে এবং কলকাতাতেই থাকি। সত্যি কথা লিখিনি। এখন সত্যি কথাগুলো লিখছি।

Advertisement

রুকনুজ্জামান রনি

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৫ ১২:১৩
Share:

অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের চিন্তায়? উত্তর চব্বিশ পরগনার হাকিমপুর সীমান্তের কাছে বিএসএফ চেকপোস্টের বাইরে অপেক্ষায় বাংলাদেশে ফিরতে চাওয়া অনুপ্রবেশকারী পরিবার। ইনসেটে রুকনুজ্জামান রনি। —নিজস্ব চিত্র।

এই হাকিমপুরে আমাকে অনেকে খোঁচা দিচ্ছে। দু’দিন ধরে রাস্তায় পড়ে আছি। রাতারাতি সংসার গুটিয়ে বাংলাদেশে ফিরতে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও আমার ফ্যাশন কেন কমে না!

Advertisement

যারা খোঁচা দিচ্ছে, তারাও আমারই মতো চোরাপথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছিল। পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর শুরু হয়েছে বলে তারাও এখন দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। তারাও আমার আশপাশে শুয়ে-বসে আছে দু’দিন ধরে। বিএসএফ কখন এই হাকিমপুর চেকপোস্টের গেট খুলে আমাদের ভিতরে নিয়ে যাবে, তার অপেক্ষায়। তার পরে কখন ও পারের বিজিবি, মানে আমাদের দেশের বাহিনী আমাদের ঢুকতে দেবে। আমার অবস্থা আর তাদের অবস্থায় খুব একটা ফারাক নেই এখন। তবু কারও কারও আমাকে দেখে একটু খোঁচা দিতে ইচ্ছা করছে।

আমি বরাবর শৌখিন। বাংলাদেশে থাকতেও পোশাক-আশাকের বিষয়ে একটু আলাদাই ছিলাম। লুঙ্গির চেয়ে জিন্‌স আর টি-শার্ট আমার ভাল লাগত। এখন শীত পড়ে গিয়েছে। এখানে আরও বেশি ঠান্ডা। রাস্তার দু’পাশে মাত্র কয়েকটা দোকান ছাড়া চারপাশে ধু-ধু মাঠ। সূর্য ডুবলেই শিরশিরানি শুরু হচ্ছে। সন্ধের পর আরও ঠান্ডা। খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হচ্ছে। তাই একটা গরম কাপড়ের তৈরি টি-শার্ট পরেছি। মাথায় ব্যান্ডানা আছে। তবে ফ্যাশনের জন্য নয়। কান ঢাকতে। যাতে শীত না করে। এখানে সে সব অনেকের চোখে লাগছে। বাংলাদেশে থাকতেও আমার পোশাক-আশাক লোকের চোখে লাগত।

Advertisement

২০ বছর বয়সে বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে এসেছিলাম। গ্রামে রুজিরুটি যোগাড় করা কঠিন হয়ে উঠছিল। দালাল বলেছিল, ভারতে ঢুকিয়ে দেবে। কাজের যোগাযোগও পাইয়ে দেবে। মাথাপিছু হাজার পাঁচেক করে দিয়ে গোটা পরিবার এক রাতে বড় একটা নদী পেরিয়ে ঢুকেছিলাম। কোথা দিয়ে ঢুকেছিলাম অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। তবে সুন্দরবন ঘেঁষা এলাকার কোনও নদী পেরিয়েছিলাম বলে মনে আছে। ঘাট থেকে নিয়ে গিয়ে হাসনাবাদ-শিয়ালদহ লোকালে তুলে দেওয়া হয়েছিল। বলেছিল, বিধাননগর রোড স্টেশনে নেমে পড়তে।

একটা ভাল জীবন আর শান্তির জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে ঢুকেছিলাম। তবে শুধু ঢুকলেই তো হয় না। থাকতে ভারতীয় কাগজপত্রও লাগে। বাংলাদেশ থেকে যারা আসে, তার প্রথমে ওই কাগজপত্র জোগাড়ের কাজটাই করে। আমরাও প্রথমে সেটাই করেছিলাম। খুব কঠিন কিছু নয়। একটু খরচখরচা হয়। এ দেশের অফিস-কাছারিতে বসে থাকা বাবুরাই কাজ করে দেন। সবচেয়ে আগে আধার কার্ড। তার পরে প্যান কার্ড আর ভোটার কার্ড করা সহজ। সেটার একটা রাস্তা আছে। আমারটা যেমন হয়েছিল। প্রথমে আমার বাবার নামের সঙ্গে মেলে, এমন একটা লোককে সরকারি ওয়েবসাইট থেকে খুঁজে বার করা হয়েছিল। তার আধার কার্ড ছাপিয়ে আমার বাবার আধার কার্ড হিসাবে জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার ঠিকানা আর আমার ঠিকানা তো মিলবে না। তাই এলাকার পঞ্চায়েত থেকে আমার নামে ‘রেসিডেনশিয়াল সার্টিফিকেট’ বার করে নেওয়া হয়েছিল। জন্মের সার্টিফিকেটও পঞ্চায়েত অফিস থেকেই পেয়ে গিয়েছিলাম। এগুলো জমা দিতে পারলেই আধার কার্ড বেরিয়ে যায়। মাথাপিছু ২৫ হাজার টাকা মতো চায়। যার যেমন ক্ষমতা, সেই অনুযায়ী দর কষাকষি করে ২০ হাজার, ১৫ হাজারেও খরচা নেমে যেতে পারে। আমাদের বাড়ির সকলের জন্য ২০ হাজার করে দিতে হয়েছিল। আধার কার্ড হাতে আসার পরে প্যান কার্ড পেতে সমস্যা হয়নি। অনেকে জিজ্ঞাসা করছে, আমার ভোটার কার্ড হয়েছিল কি না। অনেকেরই হয়েছিল জানি। তবে আমাদের হয়নি।

আমার নাম রুকনুজ্জামান রনি। সকলে রনি বলেই ডাকে। বয়স ২৪। বাড়ি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ‍্যামনগর থানা। গ্রামের নাম নওয়াবেঁকি। হাকিমপুর থেকে সোনাই পেরিয়ে বাংলাদেশে পা রাখার পরে বাড়িতে পৌঁছোতে ঘণ্টা তিনেক লাগবে। কিন্তু রওনা কতক্ষণে হব বা কত দিনে জানি না। আমার পরিবারের কেউই জানে না। রাতে পাউরুটি-কলা খেয়ে রাস্তার ধারে পলিথিন বিছিয়ে বাকিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার চোখ জ্বলছে, কিন্তু ঘুমোতে পারছি না। দাঁড়িয়ে থাকছি, হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমার মা হাতে জ্বলন্ত ধুপ নিয়ে জেগে বসে আছে। ধুপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মশার দাপট থেকে বাবা আর বোনকে বাঁচাচ্ছে। আমিও সকলকে বাঁচানোর কথাই ভাবছি। ও পারে গিয়ে কী করব, কোন পথে আয় করব, কী উপায়ে পরিবারের সকলকে নিয়ে ভাল থাকব, সারা ক্ষণ সে সবই মাথায় ঘুরছে। কিন্তু কী করে যে কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না।

এ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে মজুরির ফারাক এখন খুব বেশি নয়। কিন্তু বছর দুয়েক আগেও অনেক ফারাক ছিল। আমি জামাকাপড়ের কাজ করি। বাংলাদেশে এই কাজে মাসে সাড়ে ছ’হাজার বাংলাদেশি টাকার একটু বেশি পাওয়া যেত। তার মানে ভারতের টাকায় বড়জোর হাজার পাঁচেক। আর এখানে কাজে ঢুকেই মাসে ১০ হাজার টাকার মতো পায়। শহরে হলে আরও বেশি। যারা ভাল কাজ জানে, তারা এখানে মাসে সাড়ে ১২ হাজারের মতো কামায়। এখানে আমরা ইচ্ছে করলে মাসিক মজুরির বদলে দিনের হিসাবেও কাজ করতে পারতাম। দিনে ৪০০ থেকে প্রায় ৫০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি। কাজ কেমন জানি, তার উপরে নির্ভর করে। সব মালিক এই রেট দিতে বাধ্য। সরকারই মজুরি বেঁধে দিয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারি রেট রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ মালিকই তা মানে না। বাংলাদেশে ইচ্ছেমতো কোনও দিন কাজ করলাম, কোনও দিন করলাম না, তা হবে না। কাজ পাওয়াও কঠিন। ভারতে আমরা ভাইবোন একসঙ্গে কাজ করছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের কোনও কাজ ছিল না। এখানে আরও সুবিধা আছে। সরকার রেশন দেয়। মাসে মাসে টাকা দেয়। মহিলাদের দেয়, বয়স্কদের দেয়। হাসপাতালে বিনাপয়সায় চিকিৎসা হয়। এগুলো তো উপরি পাওনা।

ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘ফ্রম কলকাতা। লিভ্‌স ইন কলকাতা।’ মানে আমি কলকাতার ছেলে। কলকাতাতেই থাকি। এমনকি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি বলেও লিখেছিলাম। সত্যি কথা লিখিনি। কিন্তু আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। এই পরিচয় দিলে এখানে মিশে যাওয়া সহজ হয় বলে লিখেছিলাম। এমনিতে আমি বিশ্ববিদ্যালয় কেন, কলেজেও যাইনি। এখন যখন বাংলাদেশে ফেরার জন্য রাস্তায় বসে আছি, তখন সত্যি কথাগুলো লিখছি।

আমাদের সাতক্ষীরা, যশোহর বা খুলনা থেকে যারা ভারতে আসে, তাদের প্রায় সকলকেই বিধাননগর রোড স্টেশনে নামতে বলা হয়। স্টেশন থেকে বেরিয়ে সোজা বিধাননগর, নিউ টাউন, রাজারহাট আর ভিআইপি রোডের পাশের বিভিন্ন বস্তিতে। আমার পাশে এখন যে দাঁড়িয়ে আছে, সেই আলিম গাজি থাকত আটঘরায়। মানে সিটি সেন্টার টু-এর পিছনে। বাগুইআটি-জোড়ামন্দিরে রিকশা চালাত। আমার কাকা থাকছিল ইকো পার্কের পিছনে ঘুনি বস্তিতে। খালের উপর ঝুলতে-থাকা টিনের বাড়িতে। জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজ করত। আমরা অবশ্য ধুলাগড় চলে গিয়েছিলাম। সেখানে বাড়ি ভাড়া করে থাকতাম। মেয়েদের জামাকাপড় তৈরির কারখানায় কাজ নিয়েছিলাম। কিছু দিন পরে বোনকেও সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। ভাইবোনের রোজগারে সংসার চলছিল। কিছু টাকাপয়সা জমছিল। বোনের বিয়ে দেওয়া বাকি। সেখানে বড় খরচ আছে। আমি এখনও বিয়ে করিনি। করলে সেখানেও খরচ হবে। রোগ-বালাই কখন আসে বলা যায় না। তাই ক’টা পয়সা বাঁয়ে তো রাখতে হয়।

ক’টা পয়সা বাঁয়ে রাখার জন্যই ভারতে আসা। রোজের মোটা ভাতকাপড় হয়তো বাংলাদেশে থাকলেও জুটে যেত। কিন্তু একটু টাকাপয়সার মুখ দেখতে চার বছর আগে এসেছিলাম। আমার আর এক কাকা এখনও নওয়াবেঁকিতেই থাকে। তার এক ছেলে মুদিখানার মাল বেচে। একজনের জুতোর দোকান। আর একজন ইটভাটায় কাজ করে। দোকানদারিতে তেমন রমরমা নেই। বরং ইটভাটায় যে কাজ করে, তার আয় ভাল। কিন্তু সে অমানুষিক খাটুনি! সকলে পারে না। শীতের মরসুমেই ইটের কাজ বেশি হয়। কনকনে শীতে রোজ রাত ৩টে থেকে কাজে লাগতে হয়। সূর্য ডোবা পর্যন্ত চলে। বাংলাদেশের ইটভাটায় বাঁধা মাসিক মজুরিতে কাজ হয়। মজুরি ভাল। কিন্তু যতক্ষণ বলবে, ততক্ষণ কাজ করতে হবে। শরীরের হাল বুঝে কম বা বেশি কাজ করার উপায় নেই।

আমরা আর কাকারা একসঙ্গেই এলেও এক জায়গায় থাকিনি। আমি, বাবা-মা কেউ জঞ্জাল ফেলার কাজ পছন্দ করি না। ওইসব ছোট কাজ করতে হলে আর বাংলাদেশ ছেড়ে এত ঝুঁকি নিয়ে আসব কেন! বিধাননগর রোড স্টেশনে একসঙ্গে নামলেও আমাদের আর কাকাদের রাস্তা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্য দেখুন! ভারতের মাটিতেই আবার সবাই এক জায়গায় এলাম। কিন্তু মাথার উপরে এখন ছাদটুকুও নেই।

আমাদের মতো লোকেদের যে ভিড় জমেছে হাকিমপুর চেকপোস্টের বাইরে, তাতে আমার বয়সি ছেলেপুলো আরও বেশ কিছু রয়েছে। বেশির ভাগই বিয়ে করে ফেলেছে। আমি করিনি। এ দেশে নিজের একটা বাড়ি করব ভেবেছিলাম। এখন এই চেকপোস্টের বাইরে বেকার বসে আছি। বিএসএফ না ডাকা পর্যন্ত কোথাও যাওয়ার নেই, কিছু করার নেই। এখন বাংলাদেশে ফেরার অপেক্ষায় বসে আছি ঠিকই। কিন্তু মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে দয়ামায়া নেই। এখানে মানুষের দয়া আছে। যেখানে এত দিন থাকতাম, সেখানেও দেখেছি। এই হাকিমপুরেও দেখছি। আমার দেশের মতো কথায় কথায় মারা-কাটা এখানে হয় না।

বসে বসে ভাবছি, সব ভেস্তে গেল। কী কী ভেস্তে গেল, সে হিসাব অবশ্য এখনও করতে পারিনি। এখন শুধু সময়ের হিসাব কষছি। বিএসএফ আর কতটা সময় পরে আমাদের ডাকতে পারে। কখন ও পারে বিজিবির হাতে আমাদের তুলে দিতে পারে। কখন সেখান থেকে নওয়াবেঁকি যেতে হবে। তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ।

(রনি অনুপ্রবেশকারী। কথোপকথনের ভিত্তিতে অনুলিখন: ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement