মোবাইলে ভিডিয়ো দেখতে দেখতে বাস চালাচ্ছেন চালক।—নিজস্ব চিত্র।
বাসচালকের মোবাইলে ফোনটা এসেছিল। মাত্র ১০ সেকেন্ডের কথাবার্তা। কিন্তু, ছোট্ট সেই কলটাই কেড়ে নিয়েছিল ৪৬ জনের প্রাণ। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদের ওই ঘটনা থেকে যে কোনও শিক্ষাই নেওয়া হয়নি, তার প্রমাণ মিলল বৃহস্পতিবার রাতের চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে। স্টিয়ারিংয়ের সামনে রাখা মোবাইলে ডান্স আইটেম চালিয়ে বাস ছোটালেন চালক! মোবাইল ভিডিয়োর সেই গান সজোরে তখন বাজছে বাস জুড়ে।
গোটা রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রচার-প্রদীপের তলায় যে কতটা অন্ধকার লুকিয়ে রয়েছে, তা বুঝিয়ে দিলেন ধর্মতলা-ব্যারাকপুর ৭৮ নম্বর রুটের ওই বাসচালক। রাত তখন প্রায় ন’টা। চাঁদনিচক এলাকার ই-মলের সামনে থেকে বাসে উঠেই শোনা গেল গম গম করে বাজছে, ‘মোর অঠরা সাল হোই গেলাক রে... শাদি করাই দে রে বাপু...’।
ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগোতেই নজরে এল সেই দৃশ্য। দু’হাতে স্টিয়ারিং ধরা চালকের চোখ তাঁরই সামনে রাখা মোবাইল স্ক্রিনে। সেখানে তখন নাচছেন দুই তরুণ-তরুণী। সিগন্যালে আটকে পড়লে চালকের চোখ পুরোটাই ওই স্ক্রিনে। সেই সময় তিনি উপরে হাত বাড়িয়ে সাউন্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন। আওয়াজ একটু কমিয়ে দিচ্ছেন। বাস চলতে শুরু করলেই, ফের বাড়িয়ে দিচ্ছেন আওয়াজ। বাস চালাতে চালাতে তাঁর চোখ মাঝে মাঝেই ওই স্ক্রিনে।
আরও পড়ুন: লকারে চেক, সেই চেকেই চিকিৎসকের অ্যাকাউন্ট থেকে গায়েব ২০ লাখ
আরও পড়ুন: শোভন কাউন্সিলরের পদ ছাড়লে স্বাগত, ভাবী মেয়র ফিরহাদকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন রত্না
ভিড় চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে এমনিতেই বাসের গতি ২০-র উপরে ওঠা কঠিন। কিন্তু, শ্যামবাজার পেরিয়ে বাস বিটি রোডে পড়তেই সেই গতি বেড়ে দাঁড়াল ৩০-৪০এ। চিড়িয়ামোড় পেরনোর পর সেটাই মাঝে মাঝে ৫০ ছুঁই ছুঁই। মোবাইল কিন্তু তাতেও বন্ধ হয়নি। একের পর এক ডান্স আইটেম বেজে গিয়েছে বাসে। চালককেও দেখা গিয়েছে বাস চালাতে চালাতে মোবাইলে গান বদলাতে।
ভিড় বাসে চালকের পিছনে এবং বাঁ দিকের আসনগুলিতে অনেক যাত্রীই এই দৃশ্য দেখে চমকে গিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন, ‘এটা ঠিক হচ্ছে না’, ‘বাস চালাতে চালাতে এ ভাবে ভিডিয়ো দেখবেন!’, ‘অন্যায় করছেন উনি’ ইত্যাদি বাক্যে। এক জন একটু গলা বাড়িয়ে বললেনও চালককে, ‘দাদা ভিডিয়ো দেখতে দেখতে বাস চালাবেন না।’ কিন্তু, গানের আওয়াজ পেরিয়ে সেই অনুরোধ পৌঁছল কি চালকের কাছে? হাবেভাবে বোঝা গেল না। অনেকেই নামলেন, উঠলেন। কিন্তু, গান বন্ধ হল না। নামার সময় দেখা গেল বাসের নম্বর ডব্লিউ বি ০৭ জে ৩১৩৪। কন্ডাকটর যে টিকিট দিয়েছিলেন, তাতেও ওই নম্বরই লেখা।
৭৮ রুটের ওই বাসের টিকিট।—নিজস্ব চিত্র।
এ ভাবে মোবাইলে ভিডিয়ো দেখতে দেখতে বাস চালানো কি উচিত?
জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটের আওতাতেই ৭৮ রুটের বাস চলে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্নটা শুনে বললেন, ‘‘একেবারেই বেআইনি। বার বার বলা হয়েছে, গাড়ি চালানোর সময় কোনও ভাবেই মোবাইল ব্যবহার করবেন না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বাস চালানোর সময়ে কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শোনা বা মোবাইলে কথা বলা একদমই উচিত নয়। প্রতিটা রুটের বাসচালককে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু এ বার যে ঘটনার কথা শুনলাম, সেটা তো আরও গুরুতর। বাস চালাতে চালাতে ভিডিয়ো দেখছেন চালক! কোনও ভাবেই এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা অভিযোগ পেলেই কড়া পদক্ষেপ করব।’’ যে চালক ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন সেই বাসের নম্বর এবং উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিটি রোডের একটা বড় অংশ ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের মধ্যে পড়ে। ঘটনার কথা শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছেন কমিশনারেটের এক কর্তা। তিনি বলেন, ‘‘এই কাজ একেবারেই আইনবিরুদ্ধ। চালকের লাইসেন্স সাসপেন্ড হওয়ার মতো অপরাধ। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি, ঠিক কী ঘটনা ঘটেছিল।’’