প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় তৈরি সবংয়ের বিষ্ণুপুর যাওয়ার রাস্তা এমনই বেহাল। —নিজস্ব চিত্র।
প্রতি পদে অপেক্ষা করে রয়েছে বিপদ!
হেলেদুলে চলেছে বাস। একটু বেসামাল হলেই আর রক্ষে নেই। খন্দপথে গর্ত বাঁচিয়ে চলাই চ্যালেঞ্জ। বর্ষাকালে জল থইথই পথে যাতায়াত দায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার অধিকাংশ রাস্তার এখন এমনই হাল। জেলায় পূর্ত দফতরের অধীন সড়কগুলিরও জীর্ণ দশা। সোমবার কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তার জন্য প্রায় ১৯০০০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করেছেন। জেলার বাসিন্দাদের আশা, এ বার অন্তত হাল ফিরবে গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তার।
গ্রাম সড়ক যোজনার অনেক রাস্তা দেখে বোঝার উপায় নেই, রাস্তা পাকা না কাঁচা। বছরের পর বছর রাস্তার সংস্কার না হওয়ায় অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। কেন রাস্তাগুলি সংস্কার করা যায়নি? প্রশাসন জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা তৈরির ৫ বছর সময় পর্যন্ত রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব রাস্তা তৈরির বরাতপ্রাপ্ত ঠিকাদার সংস্থার। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলে রাস্তা সংস্কারের জন্য রাজ্য সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। জেলা প্রশাসন সূত্রে দাবি, জেলার গ্রাম স়ড়ক যোজনার রাস্তাগুলি সংস্কারের জন্য অর্থ চাওয়া হয়েছে। টাকা পাওয়া গেলেই রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হবে। জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ বলেন, “ধীরে ধীরে সব খারাপ রাস্তাগুলিই সংস্কার করা হবে। যে রাস্তাগুলির অবস্থা খুব খারাপ, সেগুলি সংস্কারের জন্য অর্থ পাওয়া গিয়েছে। দ্রুত কাজও শুরু হবে।”
বেলপাহাড়ি থেকে চাকাডোবা, নছিপুর থেকে কলাবনি, শ্রীনগর থেকে জগন্নাথপুর, মণ্ডলকুপি থেকে গোবিন্দপুর, ঝাঁকরা থেকে বালা, আকন্দি থেকে বিলাসবাড় - রাস্তাগুলিতে চলাই দায়। খড়িকা থেকে আধাসিমলা, করকাই থেকে বলপাই, গোবর্ধনপুর থেকে কলোড়া, পিংলা থেকে কালুখাঁড়া, মনোহরপুর থেকে প্রহরাজপুর রাস্তাও তথৈবচ। একই অবস্থা পূর্ত দফতরের অধীনে থাকা গড়বেতার ধাদিকা থেকে ফুলবেড়িয়া হয়ে সন্ধিপুর যাওয়ার রাস্তা, চন্দ্রকোনা থেকে পলাশচাবড়ি হয়ে শ্রীনগর, মোহনপুর থেকে পাথরা রাস্তাগুলিও বেহাল।
আগে যেখানে ১০ কিলোমিটার রাস্তা যেতে ১০ মিনিট সময় লাগত এখন আধ ঘণ্টাতেও পৌঁছনো কঠিন। ধীর গতিতে চললেও যে কোনও সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। অথচ গ্রাম সড়ক যোজনার এক একটি রাস্তার উপর দিয়ে ৫০-৬০টি গ্রামের মানুষের যাতায়াত করে। গড়বেতার বাসিন্দা শেখর সামন্তর কথায়, “সব থেকে আতঙ্কে থাকি যখন মেয়ে সাইকেল নিয়ে ওই রাস্তার উপর দিয়ে স্কুলে যায়। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত চিন্তা দূর হয় না।” পলাশচাবড়ির বাসিন্দা গৌরহরি পাত্রের কথায়, “আগে ছ’মাস ছাড়া একবার মোটরসাইকেলের সার্ভিসিং করাতে হত। এখন ১৫ দিন ছাড়া মোটরসাইকেল গ্যারাজে নিয়ে যেতে হয়।”
বিভিন্ন কাজে প্রতিদিন ঝাঁকরা থেকে বালা রাস্তা ব্যবহার করেন প্রহ্লাদ কারক। তাঁর কথায়, “বছরের পর বছর এই রাস্তাটি খারাপ হয়েই পড়ে রয়েছে। বর্ষা হলেই বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন যে কী দুর্ভোগে পড়তে হয়। প্রায় ১০ কিলোমিটার সাইকেলে বা মোটর সাইকেলে নেড়াদেউলে গিয়ে তবে মেদিনীপুর যাওয়ার বাস মেলে!” সিজুয়ার বাসিন্দা তপন পাত্রের কথায়, “নানা কারণে গোয়ালতোড় যেতেই হয়। ২০ মিনিটের রাস্তা যেতে এখন ৪৫ মিনিট সময় লাগে। বর্ষার আগে রাস্তা সারানো না হলে বর্ষায় এই রাস্তায় চলাচল করা যাবে না। তখন যে কী হবে, ভাবতেই পারছি না।”
গড়বেতা, পলাশচাবড়ির মতো এলাকা কৃষি প্রধান। বহু মানুষ ফসল নিয়েও এই রাস্তাগুলি দিয়ে যাতায়াত করে। রাস্তা খারাপ হওয়ায় গাড়ি ভাড়াও বাড়ছে। চাষি সুবল পালের কথায়, “আগে যেখানে ট্রাক্টরে করে আলু নিয়ে যেতে ৭০০ টাকা লাগত, এখন প্রতি বার আলু নিয়ে যাওয়ার জন্য ১০০ টাকা করে বেশি দিতে হয়।” ট্রাক্টর মালিক রবীন করের কথায়, “আমাদেরও তো খরচ বেড়েছে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তো বেড়েছেই, খারাপ রাস্তার জন্য তেলের খরচও বেশি হচ্ছে। গাড়ির চালকও বেশি টাকা দাবি করছে। খন্দপথে গাড়ি চালানো তো সহজ কথা নয়। তাই বাধ্য হয়ে আমরাও ভাড়া বাড়িয়েছি।”
দ্রুত বেহাল রাস্তার সংস্কারের দাবি জেলার বাসিন্দাদের। জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, নির্মাণের পর ৫ বছর সময় পেরিয়ে গিয়েছে, এমন বেলপাহাড়ি থেকে চাকাডোবা, নছিপুর থেকে কলাবনি, শ্রীনগর থেকে জগন্নাথপুর, মণ্ডলকুপি থেকে গোবিন্দপুর-সহ ১৯টি প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে সরকার। প্রশাসন সূত্রে খবর, রাস্তার দরপত্র আহ্বানের কাজও শেষ। এ বার দ্রুত রাস্তাগুলি সংস্কারের কাজ শুরু করে দেওয়া হবে।
রাস্তা জীর্ণ দশা নিয়ে শাসকদলকে বিঁধছে বিরোধীরা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়া বলেন, “কয়েকটি রাস্তা সংস্কারের অর্থ মিলেছে ঠিকই কিন্তু তা নিতান্তই কম। জেলার বহু রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। আরও টাকা না পেলে সমস্যা দেখা দেবে। বর্ষার আগে প্রতিটি রাস্তার কাজ করা উচিত। সংস্কার না হলে আগামী বর্ষায় অনেক খারাপ রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ের কথায়, “চারিদিকেই রাস্তার বেহাল দশা। যেটুকু টাকা বরাদ্দ হয়েছে তাতে কী হবে? এর জন্য আরও অনেক টাকা প্রয়োজন। না হলে বর্ষায় সাধারণ মানুষকে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়তে হবে। পরিবহণ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে।”