মাধ্যমিক দিতে মরিয়া মূক ও বধির বিশাখা

বিশাখা কাঁদছে কেন? নদিয়ার করিমপুরের গোয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ওই ছাত্রী লিখে জানাচ্ছে, ‘‘কবে কবে স্কুলে রেজিস্ট্রেশন হয়ে গিয়েছে। জানতে পারিনি। কেউ জানায়ওনি। টেস্টেও বসতে পারিনি।

Advertisement

কল্লোল প্রামাণিক

করিমপুর শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:১৮
Share:

পড়ুয়া: করিমপুরে বিশাখা। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।

দুয়ারে মাধ্যমিক। নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই পরীক্ষার্থীদের। সুনসান রাতে দূর থেকে ভেসে আসে ছেলেমেয়েদের পড়ার আওয়াজ। চুপ থাকে শুধু দাসবাড়ি। কিন্তু সে বাড়িতেও অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলে। সারা গাঁ জানে, বিশাখা এখনও ঘুমোয়নি। জন্ম থেকেই মূক ও বধির মেয়েটা চোখের জল মুছে নিঃশব্দে প্রস্তুত হচ্ছে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার জন্য।

Advertisement

বিশাখা কাঁদছে কেন? নদিয়ার করিমপুরের গোয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ওই ছাত্রী লিখে জানাচ্ছে, ‘‘কবে কবে স্কুলে রেজিস্ট্রেশন হয়ে গিয়েছে। জানতে পারিনি। কেউ জানায়ওনি। টেস্টেও বসতে পারিনি। এখন বলছে, আমি নাকি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারব না!’’ বিশাখার পরিবার জানাচ্ছে, মেয়ে কিন্তু এখনও হাল ছাড়েনি । সারাদিন বাড়ির কাজ করেও রাত জেগে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝেই জানতে চাইছে, ‘পরীক্ষায় বসতে পারব তো?’

বিশাখার বাবা সনাতন দাস পেশায় দিনমজুর। তাঁর অভিযোগ, স্কুলের গাফিলতিতেই মেয়েটাকে আজ এ ভাবে ভুগতে হচ্ছে। বিশাখা তো আর পাঁচ জনের মতো নয়। ওর প্রতি স্কুলের কি একটু বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া উচিত ছিল না?

Advertisement

আরও পড়ুন: কাটা হাতেই জুতোয় ফোঁড়

সনাতন সম্প্রতি করিমপুর পশ্চিম চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন, যাতে বিশাখা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে পারে। এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক সোমদেব মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের বাড়তি নজর রাখার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্কুলের উদাসীনতার কারণে সমস্যায় পড়েছে ওই ছাত্রী। বিষয়টি জেলার পরিদর্শক ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে জানানো হয়েছে।’’

স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি আশুতোষ বিশ্বাসের অভিযোগ, ‘‘প্রধানশিক্ষকের গাফিলতির কারণেই এই সমস্য। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে।’’ এমন অভিযোগ অবশ্য মানতে চাননি প্রধান শিক্ষক ভবানী প্রামাণিক। তাঁর দাবি, ‘‘রেজিস্ট্রেশনের সময় ছাত্রীটি স্কুলে না এলে আমরা কী করব? এখন চেষ্টা করছি, মেয়েটি যাতে পরীক্ষায় বসতে পারে।’’

তিন ভাইবোনের মধ্যে বিশাখা ছোট। অন্য দু’জনও মূক-বধির। দাদা বিশ্বজিৎ লেখাপড়ায় ইতি টেনে এখন রংমিস্ত্রি। দিদি জোৎস্নার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বিশাখার মা গীতা বলছেন, ‘‘ছোট থেকেই মেয়েটা লেখাপড়া নিয়েই থাকে। অভাবের সংসারেও ওকে বাধা দিইনি। গৃহশিক্ষক দিতে না পারলেও কষ্ট করে বই কিনে দিয়েছি। এখন মাধ্যমিকটা দিতে না পারলে ওকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।’’

বিষয়টি জানতে চেয়ে একাধিক বার ফোন করা হলেও ফোন ধরেননি নদিয়ার স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) মিতালী দত্ত। জবাব মেলেনি এসএমএসেরও। নদিয়ার জেলাশাসক সুমিত গুপ্তের আশ্বাস, ‘‘মেয়েটি যাতে পরীক্ষায় বসতে পারে সে ব্যাপারে শিক্ষা দফতরের সঙ্গে কথা বলছি।’’

শীতের বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসে। জ্বলে ওঠে ডুম। নিঃশব্দে বইয়ের পাতা ওল্টায় বিশাখা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন