এ বার ভিটেহারা অবোলা অনিচ্ছুকরা

উচ্ছেদের প্রথম সকালে বাজেমিলিয়ার মাঠে ইঞ্চি আটেকের পদ্মফণা মেলে ধরে সে জানিয়ে দিয়েছিল— সরে যাওয়ার এক্কেবারে ইচ্ছে নেই তার।

Advertisement

রাহুল রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৮
Share:

গোখরো, চন্দ্রবোড়া, মেঠো বেজি ও ল্যাপউইগ (ঘড়ির কাঁটা অনুসারে)

উচ্ছেদের প্রথম সকালে বাজেমিলিয়ার মাঠে ইঞ্চি আটেকের পদ্মফণা মেলে ধরে সে জানিয়ে দিয়েছিল— সরে যাওয়ার এক্কেবারে ইচ্ছে নেই তার।

Advertisement

কাজ থমকে গিয়েছিল সেই দুপুরে। জারি হয়েছিল ফরমান— ‘উচ্ছেদ পর্বে’ যেন প্রাণহানি না ঘটে। রোদচশমা মুছে জেলার এক শীর্ষ কর্তা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘ঘাস আর মাটি কাটার রোলার, ট্রিমার চালাতে গিয়ে ওদের গায়ে যেন আঁচড় না লাগে।’’ টাটাদের ছেড়ে যাওয়া ময়দান পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে দেওয়ার কর্মযজ্ঞে তাই রাতারাতি মোতায়েন হয়েছেন সাপ ধরায় করিৎকর্মা বনকর্মীরা। লম্বাটে সাঁড়াশির মতো স্নেক-ক্যাচার নিয়ে দিনভর তাঁরা মাঠের এ-মুড়ো ও-মুড়ো চষে বেড়াচ্ছেন। আগাছা সরিয়ে দেখছেন, কেউ নেই তো!

এক-আধটা তো নয়, কিলবিল করছে সাপ! সদ্য সিঙ্গুরে পা রেখে তাবড় এক মন্ত্রী কবুলই করে ফেলেছেন, ‘‘ঢের হয়েছে বাবা, সাপের ওই আড্ডাখানায় আর নয়!’’ ঘাস কাটার রোলার উলুখাগড়ার বনে গর্জন শুরু করলেই নিরাপদ দূরত্ব থেকে হল্লা করে উঠছেন ঘাসুড়েরা— ‘‘ওই তো, ঝোপের আড়ালে, ওই একটা!’’ স্টিলের ক্যাচার হাতে বনকর্মীরা ছুটছেন। তবে গত দিন পাঁচেকে খান দুয়েক নধর চন্দ্রবোড়া, মিশকালো কেউটে, লিকলিকে এক শাঁখামুটি আর বাজেমিলিয়ার মাঠে সেই সুবিশাল পদ্ম-গোখরোর দেখা মিললেও ধরা দেয়নি কেউই। দেখা দিয়েই সুড়ুত করে তারা সরে পড়েছে ঘন ঘাসবনে।

Advertisement

আশশ্যাওড়ার ঘন ঝোপ, উলুখাগড়ার বন, তেঁতুল-বকুল-খিরিশের ছায়া আর কোমর ডোবা জলা— প্রায় হাজার একরের এমন উপদ্রবহীন ঠাঁই ছেড়ে কে আর স্বেচ্ছায় সরে যেতে চায়! বছর দশেক ধরে কেউটে, গোখরো, চন্দ্রবোড়ার সঙ্গেই সিঙ্গুরের বিস্তীর্ণ মাঠে কালাচ, চিতিবোড়া, উদয়নাগের পরিপাটি সংসার। জলার ধারে দাঁড়াশ, জলঢোঁড়া, রেসার কিংবা ব্যান্ডেড রেসারের অনর্গল হুটোপুটি। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার বারোশো সাপের বসত। তাদের কয়েক জন যে ইতিমধ্যেই ঘাসুড়ের লাঠির কোপে ‘শহিদ’ হয়েছে, এমন কানাঘুষোও শোনা যাচ্ছে। এক বনকর্তা বলছেন, ‘‘আসলে অত বড় ক্যাম্পাস। আমাদের স্নেক ক্যাচারেরা রয়েছেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। খবর পেয়ে পৌঁছনোর আগেই পিটিয়ে সাপ মারলে কে আটকাবে!’’

সবাইকে ধরে-ধরে ‘পুনর্বাসন’ দেওয়া কি সম্ভব হবে? প্রধান মুখ্য বনপাল প্রদীপ ব্যাস বলছেন, ‘‘চেষ্টার তো কোনও ফাঁক রাখা হচ্ছে না!’’ কী করবেন? বনকর্তারা জানাচ্ছেন, ধরার পরে সাপেদের ছেড়ে দেওয়া হবে আশপাশের কোনও প্রাকৃতিক পরিবেশে। বছর দুয়েক আগে সিঙ্গুরের ওই পাঁচিল ঘেরা চত্বরেই অবশ্য সমীক্ষা করেছিল স্থানীয় একটি সংস্থা, ‘শিমুলতলা কনজারভেশনিস্ট’। সংস্থাটির পক্ষে সর্প বিশেষজ্ঞ বিশাল সাঁতরা দাবি করছেন, ‘‘কেউটে হোক কিংবা শঙ্খচূড়, পাঁচ থেকে সাত বিঘার নির্দিষ্ট চারণভূমির বাইরে যায় না। নতুন এলাকায় তারা কি বাঁচবে?’’

হাজারখানেক সাপের এমন পরিণতির কথা ভেবে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ছে সর্পবিশারদ এন কে রেড্ডির কপালে। বলছেন, ‘‘ঠিক এমনটা হয়েছিল হায়দরাবাদে। সাইবারাবাদ হওয়ার সময় অন্তত হাজার দেড়েক সাপ মারা পড়েছিল।’’ বছর দশেক আগে মহারাষ্ট্রে একটি নতুন শহর গড়ার সময়েও সর্প-বংশ ধ্বংসের ইতিহাস মিলছে ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র রিপোর্টে। সিঙ্গুরের কৃষিজমিতে যখন কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল, তখনও কিছু সাপখোপ মারা পড়ে। সানাপাড়ার বৃদ্ধ গ্রামবাসী মনে করতে পারেন সে কথা। তার পর দশ বছর এই তল্লাটে মানুষের পা পড়েনি। প্রাণীবিদ শীলাঞ্জন ভট্টাচার্য মনে করছেন, ‘‘এই ক’বছরে সিঙ্গুরের ওই মাঠ পাখিদেরও অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছিল।’’ পানকৌড়ি থেকে কাদাখোঁচা, ডাহুক, জ্যাকনা, কুবো, বাবুই, মুনিয়া, মৌটুসি আর অন্তত তিন কিসিমের মাছরাঙার দেখা মেলে সেখানে। স্থানীয় একটি প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠনের সমীক্ষা বলছে— টাটার মাঠে নিপাট সংসারী হয়েছে কয়েকশো মেঠো বেজি, খান ত্রিশেক গোসাপ, বেশ কিছু শেয়াল, খান চারেক মেছো বেড়ালের পরিবার।

আর সেই ল্যাপউইগ (টিটি পাখি) দম্পতি? স্তব্ধ কারখানার শেডের নীচে উলোঝুলো কংক্রিটের স্ল্যাবের আড়ালে ঘর বেঁধেছিল তারা। এক বনকর্তা বলছেন, ‘‘আমাদের দেখেই বিপদ আঁচ করে সে! তেড়ে এসে, ডানা ঝাপটে সে প্রবল প্রতিরোধ!’’

জেসিবি মেশিনের সামনে সেই পাখি এখন সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক মুখ’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন