মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে থাকা ভানু গোপন জবানবন্দি দিতে না পারায় কি তদন্ত ধাক্কা খাবে? আশঙ্কা বিভিন্ন মহলের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় মঙ্গলবার বিস্ফোরণের ঘটনার পর অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ওড়িশায় পালিয়ে গিয়েছিলেন মূল অভিযুক্ত কৃষ্ণপদ বাগ ওরফে ভানু। ভর্তি করানো হয়েছিল পড়শি রাজ্যের কটকের রুদ্র হাসপাতালে। ওড়িশা পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে সেখানে পৌঁছেও গিয়েছিলেন সিআইডির আধিকারিকেরা। গ্রেফতারও করা হয় ভানুকে। কিন্তু মধ্যরাতে মৃত্যু হয় বেআইনি বাজি কারখানার মালিকের। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে থাকা ভানু গোপন জবানবন্দি দিতে পারেননি। ফলে তদন্ত ‘ধাক্কা’ খেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। অন্য একটা অংশের মতে, ভানুর মৃত্যুতে তদন্তের গতি কমলেও তা কোনও ভাবেই আটকাবে না। মূল অভিযুক্তের বয়ান না থাকলেও, তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর যা যা দরকার, তার প্রায় সবই রয়েছে।
বৃহস্পতিবার হাসপাতাল সূত্রে খবর মিলেছিল, মঙ্গলবার রাত ২টো নাগাদ সেখানে নিয়ে আসা হয় ভানুকে। হাসপাতালে ভর্তি করানোর সময় ভানুর আত্মীয়েরা জানিয়েছিলেন, রোগী ওড়িশার বালেশ্বরের বাসিন্দা। তাঁর একটি আধার কার্ডও দেখানো হয়। বলা হয়, পারিবারিক অনুষ্ঠান চলাকালীন রান্না করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন তিনি। এর পরেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কটক সদর থানায় যোগাযোগ করে। খবর পাওয়া মাত্রই ওড়িশা পুলিশ খোঁজখবর করে গোটা বিষয়টি জানায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে। এর পরেই সিআইডির আধিকারিকেরা হাসপাতালে গিয়ে ভানুকে গ্রেফতার করেন। কিন্তু হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ভানুর গোপন জবানবন্দি নেওয়া যায়নি। বৃদ্ধের মাথা, বুক, কোমর, পা সম্পূর্ণ দগ্ধ ছিল। পুড়ে গিয়েছিল শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশই। যার জেরে কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না ভানু। সাধারণত মৃত্যুকালীন জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিকিৎসকের উপস্থিতিতে নেওয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে তার ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয়নি।
তদন্তকারীদের একাংশের আশঙ্কা, মূল অভিযুক্তের মৃত্যুতে তদন্তের গতি শ্লথ হওয়ার আশঙ্কা। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের ঘটনায় মূল অভিযুক্তের বয়ান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়। তদন্তের গতিপথ কী হবে, তার সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কী ভাবে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল, এই বেআইনি কারবারই বা কী ভাবে চলল, কোথা থেকে বাজি তৈরির কাঁচামাল আসত— এই সমস্ত কিছুই ভানুর থেকে জানা জরুরি ছিল বলে মনে করছেন তাঁরা।
স্থানীয় সূত্রে খবর, ভানু বাড়ি থেকে ১০০ মিটার দূরে নিজেদের ফাঁকা জমিতে টিনের ছাউনি দিয়ে তিনটি ঘর করেছিলেন। সেখানে রান্নাঘর, শৌচালয়ের পাশাপাশি বাজি তৈরির কাজও চলত। কাজ করতেন মূলত মহিলারা। মঙ্গলবার সকালেও বাজি বানিয়ে উঠোনে শুকোতে দেওয়া হয়েছিল। তখনই কোনও ভাবে আগুন লেগে যায়। এলাকাবাসীর দাবি, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজি তৈরির কারবার চালাচ্ছিলেন ভানু। তাঁর তৈরি বাজির চাহিদাও ছিল বিপুল। ভানুর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূরদূরান্তে। ক্রমেই ভানু হয়ে ওঠেন এলাকার সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীদের অন্যতম। ২০১১ সালে রাজ্য তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে শাসকদলে ভানুর ওঠাবসা শুরু হয়। তবে রাজনীতি নিয়ে সে ভাবে মাথা ঘামাতেন না ভানু। ব্যবসাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। প্রথমে ভানুর কারখানা ছিল গ্রামের বাড়িতে। সেখানে ১৯৯৫ সালে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। সে বার পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০১ সালে ফের বিস্ফোরণ কেড়ে নেয় ভানুর ছোট ভাই বিষ্ণুপদ বাগ-সহ তিন জনের প্রাণ। তার পরেও এলাকায় বার বার তল্লাশি হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। ভানু ধরাও পড়েছেন। কিন্তু জামিন পেয়ে ফের শুরু করেছেন কারবার।
স্থানীয়দের কেউ কেউ বলেন, রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকার সুযোগে বাড়ি ফিরে এসে পুনরায় নতুন বাজি কারখানা গড়ে তোলেন ভানু। কারখানায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয় প্রায় দেড়শো মিটার পাকা রাস্তা। ২৫ থেকে ৩০ জন কর্মী নিয়ে নতুন করে শুরু হয় কাজ। বাজি আর মশলা রাখতে কারখানার পাশেই তৈরি হয় গোপন কুঠুরি। নিয়মমাফিক বাজি তৈরির কারখানার জন্য লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। পরিবেশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অনুমতিপত্র, অগ্নি নির্বাপণ দফতরের ছাড়পত্র এবং স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু, এই সব ছাড়াই বিভিন্ন এলাকায় রমরমিয়ে চলছিল বাজির কারবার। বার বার প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ, পুলিশে অভিযোগ দায়ের হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে এত দিন ধরে কারবার চলল, সে ব্যাপারে ভানুর বয়ান তদন্তের স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছিলেন তদন্তকারীরা।
তবে পাল্টা অভিমতও রয়েছে। তদন্তকারীদের অন্য একটি অংশের বক্তব্য, ভানুর মৃত্যুতে বড়জোর তদন্তের গতি কমতে পারে। কিন্তু তদন্ত কোনও ভাবেই আটকাবে না। ইতিমধ্যেই ফরেন্সিক দল ঘটনাস্থলে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেছে। তার রিপোর্ট শীঘ্রই হাতে আসবে। এ ছাড়াও ‘সিডি-আর’ বিশ্লেষণ করে ‘বি-পার্টি’ নিশ্চিত করা সম্ভব। যার অর্থ, ভানুর ফোন থেকেই অনেক তথ্য হাতে আসতে পারে। জানা যেতে পারে তাঁর সঙ্গে কাদের যোগাযোগ ছিল, কারা বাজির বরাত দিতেন ইত্যাদি।
বিস্ফোরণের ঘটনায় ইতিমধ্যেই ভানুর দুই সঙ্গী ছেলে পৃথ্বীজিৎ এবং ভাইপো ইন্দ্রজিৎ বাগকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইন্দ্রজিৎকে কাঁথি মহকুমা হাসপাতালে হাজির করিয়ে ৮ দিনের জন্য হেফাজতেও নিয়েছে সিআইডি। আর পৃথ্বীজিৎকে ওড়িশা থেকে আনার প্রস্তুতি চলছে। বিস্ফোরণে অনেকে আহতও হয়েছেন। তাঁদের সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই গোটা কারবার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে। সাক্ষী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদেরও অভাব নেই! শুধু তা-ই নয়, স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, গ্রামের গরিব লোকজনকে কখনও হুমকি দিয়ে, কখনও সাহায্যের নামে ঋণের জালে বেঁধে বাজি তৈরিতে বাধ্য করতেন ভানু। তাঁদেরও কাছ থেকেও পারে অনেক তথ্য মিলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজ্যের প্রাক্তন ডিআইজি পঙ্কজ দত্ত বলেন, ‘‘প্রমাণ জোগাড় করে সব সূত্রগুলি জুড়তে তদন্তকারী সংস্থার একটু সময় লাগতে পারে। কিন্তু চার্জশিট দিতে অসুবিধে হবে না। ভানু মারা যাওয়ায় তদন্ত সামান্য দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তদন্ত থামবেও না।’’