এল নিনোর হুঙ্কার উপেক্ষা করে নিম্নচাপ আর ঘূর্ণাবর্তের পালে ভর করে ক্রমেই খরার আশঙ্কা কাটিয়ে উঠছে দেশ।
চলতি বছর এল নিনোর বছর। এর সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষার অহি-নকুল সম্পর্ক। এল নিনো জোরদার হলে বর্ষার ভাগ্য পোড়ে।
এ বার এপ্রিলের গোড়াতেই মৌসম ভবন জানিয়ে দিয়েছিল, এল নিনোর জেরে বর্ষার মুখ পুড়বে। দেশের বড় একটা অংশে অনাবৃষ্টি এবং খরার পূর্বাভাস দিয়েছিল মৌসম ভবন। এল নিনোর প্রতিপক্ষ হিসেবে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণাবর্ত যে এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, তা আগাম বুঝতে পারেননি আবহবিদেরা। তাই জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে বর্ষা একেবারে স্বাভাবিক। মৌসম ভবন সূত্রের খবর, জুলাইয়ের বাকি সময়টা বর্ষার এই ছন্দটা থাকলে খরার পূর্বাভাস তুলে নেওয়া হবে।
জুন মাসে সারা দেশে বর্ষার পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি। বিশেষ করে গুজরাত, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এবং মধ্য ভারতে যত বৃষ্টি হয়েছে, গত ৫০ বছরে তা হয়নি। বহু দিন পরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে বর্ষা ফিরেছিল স্বাভাবিক ছন্দে। মেঘালয়ের মৌসিনরাম অনেক দিন পরে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত-অঞ্চলের তকমা ফিরে পেয়েছিল। জুন মাসের বৃষ্টিতে বন্যায় ভেসে গিয়েছিল অসমের বিস্তীর্ণ এলাকা। উত্তরবঙ্গেও বন্যার সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, হিমাচলপ্রদেশ এবং কাশ্মীরে বর্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। তাই এল নিনোর কী হল, আদৌ তার প্রভাব জুলাই-অগস্ট মাসে থাকবে কি না, তা নিয়ে আবহবিদদের মধ্যে শুরু হয়েছে গিয়েছে আলোচনাও।
উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে কাশ্মীরের উপরে একটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা রয়েছে। মৌসুমী অক্ষরেখা বিস্তৃত রয়েছে হিমাচলপ্রদেশ থেকে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের দিঘা পর্যন্ত। এ ছাড়া, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপরে উপকূল বরাবর দুটি ঘূর্ণাবর্তও সক্রিয় রয়েছে। আর এই চারটি প্রাকৃতিক অবস্থা একই সঙ্গে পরিমণ্ডলে হাজির থাকায় উত্তর-ভারত এবং পূর্ব ভারতে ভাল বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহবিদেরা। তবে আরব সাগর উপকূলে বর্ষা পরিস্থিতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। বর্ষা ছন্দ হারিয়েছে দক্ষিণ ভারতেও। দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র জুন মাসে অতি-বৃষ্টি হয়েছে। জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে সেখানে খুবই কম বৃষ্টি হয়েছে। মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাতেও হঠাৎ ছন্দ হারিয়েছে বর্ষা।
মৌসম ভবনের এক আবহবিদের কথায়, ‘‘মনে হচ্ছে ভারতীয় উপকূলে এখন এল নিনোর প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি। তবে সারা দেশে এই মুহূর্তে আবহাওয়া পরিস্থিতি যা তাতে জুলাই মাসের বাকি সময়টা পূর্ব ভারত এবং উত্তর ভারতে আশানুরূপ বৃষ্টি আশা করছি আমরা। অগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন থাকলে এল নিনোকে হারিয়ে দেবে বর্ষা।’’
চলতি বছরে সারা দেশে বৃষ্টির হাল কেমন? মৌসম ভবন জানাচ্ছে, ১ জুন থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ২৯৮.৯ সেন্টিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা। এ বার হয়েছে ২৮০.৮ মিলিমিটার। গত ১০ বছরে ওই সময়ে এর থেকে অন্তত ১০-১৫ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন আবহবিদেরা। তবে জুন মাসে যে রকম টি টোয়েন্টির মেজাজে বৃষ্টি ব্যাটিং করেছিল, তুলনায় জুলাইয়ে বৃষ্টিপাতের হার কিছুটা কমেছে। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে বর্ষা ব্যাটিং করেছে এক দিনের ক্রিকেটের মেজাজে। এক আবহবিদ জানাচ্ছেন, ‘‘জুলাই মাসের বাকিটা এবং অগস্ট মাসের প্রথম ১৫ দিন যদি বর্ষা টেস্ট ক্রিকেটের মেজাজেও ব্যাট করে, তবে চাষবাসের ক্ষেত্রে আর সঙ্কটের আশঙ্কা নেই।’’
গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে দেরিতে বর্ষা এলেও গত এক মাসে ঘন ঘন নিম্নচাপ অক্ষরেখা, নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণাবর্তের প্রভাবে ইতিমধ্যেই পর্যাপ্ত বৃষ্টি পেয়েছে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে দুটি ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে। তার মধ্যে একটি শক্তি বাড়িয়ে নিম্নচাপে রূপান্তরিত হতে পারে। তার ফলে আগামী কয়েক দিন দুই বঙ্গেই বৃষ্টি চলবে বলে জানিয়েছেন আবহবিদেরা। এখানে আপাতত এল নিনোর কোনও প্রভাব দেখতে পারছেন না তাঁরা।