স্বজন হারার কান্না। ভেঙে পড়েছে নিহত জামাল শেখের (ইনসেটে) পরিবার। রবিবার। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
বিদ্যুৎ-বিভ্রাট চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। স্থানীয় বিদ্যুৎ দফতরে গিয়েও তেমন সুরাহা হয়নি।
তার জেরেই রবিবার সকাল থেকে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বসেছিলেন মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা এলাকার বাসিন্দারা। সেই অবরোধের ক্ষোভই বেলা বাড়তে উত্তপ্ত করে তুলেছিল এলাকাকে।
যা সামাল দিতে পুলিশকে চালাতে হল গুলি, পাল্টা উড়ে এল ইট, বোমা। অভিযোগ, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বলিদাপুরের বাসিন্দা জামাল শেখের (২৬)। জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধে জখম হয়েছেন ন’জন পুলিশকর্মী ও আট জন বাসিন্দা। ইটের আঘাতে গুরুতর জখম হয়েছে বছর দশেকের হেনা খাতুন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ফরাক্কার আইসি সমীররঞ্জন লালাও বেনিয়াগ্রাম ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন।
পুলিশ জানিয়েছে, উত্তেজিত জনতা ১৫ টি সরকারি বাস ভাঙচুর করেছে। ভেঙে দিয়েছে পুলিশ ও বিডিও-র গাড়িও। এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে দু’টি তাজা বোমা। মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অংশুমান সাহা বলেন, ‘‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। পাল্টা গুলি ও বোমা ছুড়েছে এলাকার লোকজনও। কার গুলিতে জামালের মৃত্যু হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়।’’
রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইন শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা জানান, পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে শূন্যে তিন রাউন্ড গুলি ছুড়তে হয়। তবে মুর্শিদাবাদারে অতিরিক্ত জেলাশাসক এনাউর রহমান কবুল করছেন, ‘‘পুলিশের গুলিতে একজন মারা গিয়েছেন। জখম হয়েছেন আরও একজন।”
এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাস। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে হুকিং-এর লাইন কাটতে গেলে গ্রামবাসীরা আটকে রাখে বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীদের। তাঁদের উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দু’জন বাসিন্দা মারা গিয়েছিলেন। ২০১২ সালের নভেম্বরেও নদিয়ার তেহট্টে অবরোধ তুলতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল স্থানীয় এক বাসিন্দার।
ফরাক্কার মহেশপুর, নয়নসুখ, অর্জুনপুর ও মহাদেবনগর এলাকায় বেশ কিছু দিন ধরেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলছে। গত তিন দিনে তা চরমে পৌঁছয়। শনিবার মাইকে প্রচার করা হয়, রবিবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের প্রতিবাদে জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হবে। সেই মতো সকাল সাড়ে আটটায় ফরাক্কার জিগরি মোড়ে অবরোধ শুরু হয়। জমায়েত হন অন্তত এক হাজার মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যাটা আরও বাড়তে থাকে। এ দিকে অবরোধের গুঁতোয় রাস্তায় ব্যাপক যানজট তৈরি হয়।
খবর পেয়ে ফরাক্কা থানার পুলিশ এসে অবরোধ তুলে নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু বাসিন্দারা গোঁ ধরেন, বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা না এলে অবরোধ উঠবে না। রবিবার ছুটি থাকায় বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি পুলিশ। এ দিকে সাড়ে চার ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও অবরোধ না ওঠায় বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন আইসি সমীররঞ্জন লালা। তিনি এসে অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। তার মধ্যেই পুলিশকে লক্ষ করে ইট ছোড়া শুরু হয়। পুলিশও পাল্টা লাঠি চালাতে শুরু করে।
হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে সমীররঞ্জন বলছেন, ‘‘যে ভাবে অবরোধকারীরা আমাদের লক্ষ করে ইট, গুলি ও বোমা ছুড়তে শুরু করে তাতে আমাদের গুলি না চালিয়ে উপায় ছিল না। এ দিন যা ঘটল তাতে মনে হচ্ছে অবরোধকারীরা পরিকল্পনা করেই এসেছিল।’’ যদিও পুলিশের এমন দাবি মানতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনীতিকরা।
ফরাক্কার বিধায়ক কংগ্রেসের মইনুল হক ও সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনায় নিন্দা করে বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অতিষ্ঠ হয়েই মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। অথচ পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাল! আমরা এ কোন রাজ্যে বাস করছি?’’ ঘটনার প্রতিবাদে আজ, সোমবার জঙ্গিপুর মহকুমায় ১২ ঘণ্টার বন্ধের ডাক দিয়েছে কংগ্রেস ও সিপিএম।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের দাবি, ‘‘কংগ্রেস অবরোধকারীদের উস্কানি দিয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশ প্রতিরোধ করেছে মাত্র। তবে পুলিশের গুলি চালানোটাও ঠিক হয়নি। নিরীহ এক গ্রামবাসীর মৃত্যুও দুঃখজনক ঘটনা।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘ফরাক্কায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও কেন ওই এলাকার লোকজন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না সেটাও দেখতে হবে।’’
রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানি সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট রুখতে কাজ চলছিল। বিদ্যুৎ বন্ধ করে যে কাজ হবে সেটাও মাইকে প্রচারও করা হয়েছিল। শুক্রবার থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত ২৫ শতাংশ কাজ হয়েও গিয়েছে। তারমধ্যেই এই ঘটনা।
বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সামনে একের পর এক উৎসব। সেই কারণেই সব জায়গায় লাইন মেরামত-সহ নানা কাজ চলছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জানিয়েই কাজ চলছে। মন্ত্রীর সংযোজন, ‘‘তবে ফরাক্কায় যে ঘটনা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’