ছিন্নমূল হতে নারাজ ছিট-বাসিন্দারা

ও পারে সর্বসুখের হাতছানি। উদ্বুদ্ধ করার মতো মতলবি লোকেরও অভাব নেই। তবু ভিটে মাটি ছেড়ে শরণার্থী হওয়ার ঝুঁকি নিতে অপারগ ছিটমহলের বাসিন্দারা।

Advertisement

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৫ ০৪:২৪
Share:

অপশন নেওয়ার কাজ চলছে। বাংলাদেশি ছিটমহল মশালডাঙায়। ছবি: সাদ্দাম মিঞা

ও পারে সর্বসুখের হাতছানি। উদ্বুদ্ধ করার মতো মতলবি লোকেরও অভাব নেই। তবু ভিটে মাটি ছেড়ে শরণার্থী হওয়ার ঝুঁকি নিতে অপারগ ছিটমহলের বাসিন্দারা।

Advertisement

জুলাইয়ের ৩১ তারিখ ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত পার হলেই ৫১ বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে হবে। বাংলাদেশে চলে যাবে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল। একই সঙ্গে বদলে যাবে দু’দেশের মোট ১৬২টি ছিটমহলের ৫১ হাজার ৫৮৪ জনের নাগরিকত্ব।

এক সঙ্গে এত মানুষের নাগরিকত্ব বদল বিশ্বের ইতিহাসে বড় একটা ঘটে না। ৬৮ বছর ধরে বঞ্চনা আর কথা-না-রাখার সাক্ষী উত্তরবাংলার এই টুকরো টুকরো জনপদগুলি— এখন তাই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজরবন্দি। ৬ জুলাই থেকে সরকারি শিবির বসেছে। সেখানে গিয়ে নাগরিকত্বের অপশন দিয়ে আসছেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। বৃহস্পতিবার সময়সীমা শেষ হওয়ার তিন দিন আগেই এ কাজ সেরে ফেলেছেন ৫১ বাংলাদেশি ছিটমহলের ১৪ হাজার ২১৫ জন বাসিন্দার ৯৮ শতাংশ। আর সরকারি নথি বলছে— তাঁদের এক জনও বলেননি, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ধরে রাখার জন্য ভিটে-মাটি ছেড়ে ও দেশে অনির্দেশ যাত্রায় চলে যেতে চান তাঁরা। অর্থাত্ তাঁদের ছিটমহল ভারতে যুক্ত হলে সেখানকার বাসিন্দারা ভারতীয় নাগরিক হয়ে নিজেদের ভিটে-মাটিতেই থেকে যেতে চান।

Advertisement

আর বাকিরা? যাঁরা এখনও অপশন দেননি, তাঁরা কি নাগরিকত্ব বাছা নিয়ে দ্বিধায়? আদৌ নয়— বলছেন ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব। অনেকে বাইরে রয়েছেন, কেউ কেউ অসুস্থ বা অন্য কাজে ব্যস্ত বলে এখনও অপশন দিয়ে উঠতে পারেননি। বৃহস্পতিবারের মধ্যেই তাঁরা সে কাজ সেরে ফেলবেন। কিন্তু ভারতের নাগরিকত্ব নেওয়ার বিষয়ে দ্বিধা নেই এক জনেরও— বলছেন সমন্বয় কমিটির তরুণ সদস্য মশালডাঙ্গার বাসিন্দা সাদ্দাম মিঞা।

একই ছবি ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলেও। সময়সীমা পার হওয়ার তিন দিন আগেই ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন বাসিন্দার ৯৪% তাঁদের অপশন দিয়ে এসেছেন। হাজার খানেক মানুষ (সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী) ছাড়া প্রত্যেকে জানান, বাংলাদেশি নাগরিক হয়েই তাঁরা ভিটেতে থেকে যেতে চান। যে ১১২৭ জন ভারতীয় নাগরিকত্ব রেখে পশ্চিমবঙ্গের আসার অপশন দিয়ে এসেছেন, তাঁদের ১০৭ জন সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন। তা জানিয়ে তাঁরা সরকারি অফিসারদের কাছে চিঠিও দিয়েছেন। সমন্বয় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানান, এ প্রবণতা বাড়ছে। ভারতে আসার অপশন দিয়ে আসা আরও মানুষ সিদ্ধান্ত বদলের কথা জানিয়ে চিঠি দিতে চাইছেন।

এখনও পর্যন্ত অপশন দিয়ে আসা ভারতীয় ছিটমহলগুলির হাজার ৩৫ বাসিন্দার মধ্যে হাজার খানেক মানুষই বা কেন ভিটে-মাটি ছেড়ে ভারতে আসার অপশন দিলেন? সরকারি অফিসারেরা বলছেন, অনেকেরই ধারণা ভারতে নিরাপত্তা আর কাজের সুযোগ বেশি। ভারতীয় নাগরিক হিসেবেও তাঁরা বাড়তি সুবিধা পাবেন। পুনর্বাসনেও বেশ কয়েক লক্ষ টাকা মিলতে পারে। সমন্বয় কমিটির কর্মী জয়নাল আবেদিন জানাচ্ছেন, তাঁদের এই ধারণা তৈরি করার জন্য এক দল লোক প্রচারও করছে। দু’ধরনের লোক এই কান ভাঙানোর কাজ করছে। এক দলের লক্ষ্য ছিটমহল ছেড়ে যাওয়া পরিবারগুলির জমি-জিরেত নামমাত্র দামে কিনে নেওয়া। আর এক দল কোনও না-কোনও ভাবে বাংলাদেশের জামাতে ইসলামির সঙ্গে যুক্ত। তাদের হিসেবটা হল— ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিতে অস্বীকার করলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের মুখ পুড়বে। সেটাকে প্রচারের আলোতেও নিয়ে আসা যাবে।

সমন্বয় কমিটির নেতা দীপ্তিমানবাবু বলছেন— ছিন্নমূল হওয়ার আশঙ্কা তো রয়েইছে, পাশাপাশি এই সব মতলবি মানুষদেরও চিনে ফেলেছেন ভারতীয় ছিটমহলের গরিব বাসিন্দারা। অধিকাংশ মানুষ গোড়াতেই বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার অপশন দিয়ে তাদের চক্রান্ত ভেস্তে দিয়েছেন। যাঁরা ভারতে আসার অপশন দিয়েছেন, তাঁরাও তাই এখন সিদ্ধান্ত বদল করে চিঠি দিচ্ছেন।

কিন্তু এক বার অপশন দেওয়ার পরে তা কি বদল করার সুযোগ রয়েছে? সিদ্ধান্ত বদলের চিঠি কি গৃহীত হবে?

এ নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্ম়ী— সকলেরই বিভ্রান্তি রয়েছে। তাঁরা চিঠি নিচ্ছেন বটে, কিন্তু তা গৃহীত হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের কথাও জানাচ্ছেন। কিন্তু ভারত সরকারের পক্ষে বিষয়টি দেখার দায়িত্বে থাকা যুগ্ম বিদেশসচিব শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথন আনন্দবাজারকে জানান, ১৬ তারিখ পর্যন্ত যে কোনও ছিটমহলবাসী তাঁদের অপশন বদলাতে পারবেন। এ নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। অফিসারদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন