বেসরকারি থেকে উদ্বৃত্ত রক্ত পাচ্ছে সরকারি হাসপাতাল

রাজ্যের একটি সরকারি হাসপাতালে রক্ত নিতে আসা থ্যালাসেমিয়া ও অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া-আক্রান্ত শিশুদের বাঁচাতে লোহিত রক্তকণিকা পাঠাচ্ছে একটি বেসরকারি হাসপাতাল। এতে এক হাসপাতালের রক্তের আকাল যেমন মিটছে, তেমনই নষ্ট না হয়ে কাজে লাগছে অন্য হাসপাতালে উদ্বৃত্ত রক্ত।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:০০
Share:

রাজ্যের একটি সরকারি হাসপাতালে রক্ত নিতে আসা থ্যালাসেমিয়া ও অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া-আক্রান্ত শিশুদের বাঁচাতে লোহিত রক্তকণিকা পাঠাচ্ছে একটি বেসরকারি হাসপাতাল। এতে এক হাসপাতালের রক্তের আকাল যেমন মিটছে, তেমনই নষ্ট না হয়ে কাজে লাগছে অন্য হাসপাতালে উদ্বৃত্ত রক্ত।

Advertisement

রক্তের যথোপযুক্ত ব্যবহারের জন্য ব্লাডব্যাঙ্কগুলির মধ্যে রক্ত আদানপ্রদানের এই ব্যবস্থাকেই ‘আদর্শ’ বলেছিল ‘জাতীয় এড্‌স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা’ (ন্যাকো)। এই পথই যাতে অনুসরণ করা হয়, তার জন্য নির্দেশিকা ছিল ‘ড্রাগ কন্ট্রোল জেনারেল অব ইন্ডিয়া’রও। কিন্তু এক ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে উদ্বৃত্ত রক্ত অন্য ব্লাডব্যাঙ্কে পাঠিয়ে যথাযথ ব্যবহারের এই ‘আদর্শ’ নির্দেশিকা পশ্চিমবঙ্গে সরকারি বা বেসরকারি, কোনও স্তরেই কার্যকর করা যায়নি। বরং মহারাষ্ট্র, গুজরাত বা তামিলনাড়ুর মতো রাজ্য এতে অনেক এগিয়ে গিয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেদের সদিচ্ছা আর প্রচেষ্টায় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ এবং রাজারহাটের টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল এমন এক নজির গড়ে ফেলেছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। নিজেদের ব্লাডব্যাঙ্কের মধ্যে রক্ত আদানপ্রদানের ব্যাপারে গাঁটছড়া বেঁধেছে তারা। প্রথম পদক্ষেপে গত বুধবার, ৪ জানুয়ারি টাটা ক্যানসার হাসপাতাল থেকে ৮৫ ইউনিট প্যাক্ড সেল বা লোহিত রক্তকণিকা পাঠানো হয়েছে এনআরএসে। সেই প্যাক্ড সেল দেওয়া হয়েছে নীলরতনের ডে-কেয়ারে আসা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কিংবা অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ায় ভোগা শিশু এবং কেমোথেরাপি চলছে এমন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের। বিশেষ ভ্যানে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এই প্যাক্ড সেল নীলরতনে নিখরচায় পৌঁছে দিচ্ছেন টাটা মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ। চলতি সপ্তাহে আরও প্যাক্ড সেল পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

Advertisement

এনআরএসের হেমাটোলজির প্রধান প্রান্তর চক্রবর্তী জানান, তাঁদের কাছে ১৭০০ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু রক্ত নেওয়ার জন্য নথিভুক্ত। এদের মধ্যে ডে কেয়ারে নিয়মিত রক্ত নেয় ৫০০-৬০০ জন। নথিভুক্ত অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৩০০। এদেরও মাসে ৪-৫ বার রক্ত দিতে হয়। এ ছাড়াও রয়েছেন কেমোথেরাপির রোগী এবং সদ্য প্রসূতিরা। এঁদের প্যাকসেল বা লোহিত রক্তকণিকা দরকার। এত প্যাক্ড সেল নীলরতনের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্কে তৈরি হয় না। এর ফলে নতুন ব্যবস্থায় এই রোগীরা হাতে চাঁদ পেয়েছেন।

অন্য দিকে, টাটা মেমোরিয়ালের তরফে ব্লাডব্যাঙ্কের প্রধান সবিতা বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের ক্যানসার রোগীদের মূলত প্লেটলেট দরকার হয়। প্রতি মাসেই বেশ কিছু প্যাক্ড সেল উদ্বৃত্ত হয়ে নষ্ট হত। সেটা যদি কাজে লাগে, তা হলে এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে?’’

যদি দু’টি হাসপাতাল নিজেদের চেষ্টায় এটা করতে পারে, তা হলে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে কেন এই আদানপ্রদান চালু করা যাচ্ছে না? কেন এখনও কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে প্লেটলেট জমে নষ্ট হলে তা এসএসকেএমে পাঠানো যায় না? কেনই বা আর জি কর হাসপাতালে প্লাজমা উদ্বৃত্ত হলে পাঠানো হয় না ন্যাশনাল মেডিক্যালে?

রাজ্য এড্‌স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (স্যাক্স)-র প্রকল্প অধিকর্তা পৃথা সরকার অবশ্য মেনে নিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে এ রকম আদানপ্রদানের পরিকাঠামো গড়ে উঠতে এখনও অনেক সময় লাগবে। তিনি বলেন, ‘‘দু’টি উচ্চ মানের হাসপাতাল উদ্যোগী হয়ে নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে এটা শুরু করছে। কিন্তু এ রাজ্যে ৬০টি সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক। এদের কার কাছে কত রক্ত বা রক্তের কোন উপাদান উদ্বৃত্ত, তা জেনে উপযুক্ত কোল্ড চেন ও যানবাহনের ব্যবস্থা করে সেই রক্ত পরিবহণ করা বিশাল ব্যাপার। কোথাও একটুও ভুলচুক হচ্ছে কি না, তা দেখতে অনেক নজরদারিও দরকার। সেটা এখনই সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যতে কখনও হবে।’’

সরকারি স্তরে উদ্বৃত্ত রক্ত ও রক্তের উপাদান আদানপ্রদান যেমন কঠিন, তেমনই বেসরকারি ও সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের মধ্যেও বিষয়টি সার্বিক ভাবে শুরু হওয়া মুশকিল বলে মনে করছেন রক্ত আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত দীপঙ্কর মিত্র, অপূর্ব ঘোষেরা। তাঁদের ব্যাখ্যা, ‘‘অধিকাংশ বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক বা কর্পোরেট হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে পাঠানো রক্ত বা উপাদান নিতেই চায় না। এতে তাদের আর্থিক ক্ষতি। তারা রোগীদের নিজেদের ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে মোটা টাকায় রক্ত কিনতে বাধ্য করে। উপরন্তু ডোনার নিয়ে আসতে বলে।’’

দীপঙ্করবাবুর মতে, সরকারি হাসপাতালগুলি রক্তদান শিবির করে রক্ত সংগ্রহ করে। সেই রক্ত বেসরকারি হাসপাতালে টাকা নিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হবে। তা ছাড়া, রক্তের সঙ্কটের সময়ে তা দালালি বা রোগ লুকিয়ে রক্তদানের মতো সমস্যা তৈরি করতে পারার আশঙ্কাও থাকছে। তবে এনআরএস ও টাটা মেমোরিয়ালের এই উদাহরণকে খারাপ না বললেও এ ধরনের ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করতে হলে আগে যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে বিষয়টি নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন দীপঙ্করবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন