দিনে-রাতে সব সময়েই জমজমাট ঝাঝাঙ্গির ধাবা। দীপঙ্কর ঘটকের তোলা ছবি।
ধাবা তো নয়, যেন হাট! দিনরাত ভিড়ে ভিড়াক্কার। অথচ কোথাও নেই নেশার আসর, দেহ ব্যবসার ছোঁয়াচ, এমনকী মাছ-মাংসও।
এটাই হল ঝাঝাঙ্গি। ঝকঝকে তকতকে, দিনে বা রাতে যখনই যান, গ্রাহকের জন্য তৎপর নিরামিশ এই ধাবা। শুধু ডিম-পেঁয়াজ বাদ যায়নি এখনও। না হলে ত়ড়কা জমে না কি!
আর পানীয়? ধাবার নিত্য গ্রাহকরা বলছেন, কেন, দুধ! মাঝরাতেও চাইলেই মিলবে গরমাগরম। আর মিলবে খাঁটি দুধের রাবড়ি, পেঁড়া, জাম্বো চেহারার লাড্ডুও। এ জন্য ধাবার পেছনেই রয়েছে নিজস্ব খাটাল।
ওড়িশার গোপালপুরের মাছ ব্যবসায়ী থেকে শিলংয়ের দারচিনির পাইকার— সকলের মুখেই শোনা যায় ধাবার নাম। ময়নাগুড়ি থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে জাতীয় সড়কের ধারে যে আলো ঝলমল ধাবায় বসে নিশুতি রাতে আজও শোনা যায় শেয়ালের ডাক!
ধাবাটিকে আগলে রেখেছেন এলাকার ব্যবসায়ীরা। সারারাত খোলা থাকায় ধাবায় ঝুটঝামেলা লেগেই থাকত। মদ্যপদের হুল্লোড়, তোলাবাজদের হাঙ্গামা ছিল নিত্যকার ঘটনা। গোলমাল বাড়তে থাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তৈরি করেন, ‘ঝাঝাঙ্গি হোটেল ব্যবসায়ী সমিতি’। সিদ্ধান্ত হয়, ধাবার সামনে পান-সিগারেট, ঠান্ডা পানীয়ের দোকানগুলিও রাতভর খোলা থাকবে। ধাবায় কোনও গোলমাল দেখলেই ব্যবসায়ীরা জোট বেধে মোকাবিলা করবেন। নেশাগ্রস্তদের আড্ডা ঠেকাতে ধাবাটিও আমিষ থেকে নিরামিষে বদলে যায়। শুধু ডিম আর পেঁয়াজ বাদে।
ঝাঝাঙ্গি নাম এলো কোথা থেকে? এটা আসলে একটা নদীর নাম। অনেকের দাবি, এই এলাকার বাসিন্দাদের মুখে পঞ্জাবি তড়কার স্বাদ এনে দিয়েছিল এই নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ধাবা। নদীর নামেই ধাবার-ও নাম ঝাঝাঙ্গি। এক সময়ে ধাবায় বসতে দেওয়া হতো শক্ত দড়ি বাঁধা খাটিয়ায়। উপরে পেতে দেওয়া হতো কাঠের পাটাতন। সেখানেই পরিবেশন করা হতো গরমাগরম খাবার।
আশির দশকে তৈরি হওয়া ধাবা-ই বদলে দিয়েছে লাগোয়া এলাকার চালচিত্র। এখন সারারাত সোডিয়াম আলোয় চকচক করে জাতীয় সড়কের পাশের এলাকা। দূরপাল্লার পণ্যবাহী ট্রাক-চালকদের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা হিসেবে পরিচিত ঝাঝাঙ্গি ধাবা।
মাটি লেপা প্রায় বারোটি চুল্লিতে সব সময়ে আঁচ গমগম করছে। কোনটায় তড়কার ডাল ফুটছে, কোনটায় রুটি সেঁকা হচ্ছে। যেন যজ্ঞিবাড়ি। দিন-রাত মিলিয়ে প্রতিদিন ৮০ জন কর্মী ধাবায় কাজ করেন। এক সময়ে শুধু তড়কা খাওয়ার জন্যই জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে লোকজন ঝাঝাঙ্গির ধাবায় আসতেন। এখন প্রায় সর্বত্রই পঞ্জাবি খানা মেলে। তড়কা তো পাড়ার ছোট্ট হোটেলেও চাইলেই মিলে যায়। তবু ঝাঝাঙ্গির সামনের ভিড় কমেনি। বরং ট্রাক-চালকদের মুখে মুখে নাম ছড়িয়েছে ভিন রাজ্যেও। তাই নিরামিষেও ভিড় কমেনি।
উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা পুরণজিৎ কুমার যেমন জানালেন, তিনি ঝাঝাঙ্গির নাম শুনেছেন নিজের গ্রামেই। কারখানার যন্ত্রাংশ ট্রাকে চাপিয়ে মণিপুর যাচ্ছেন তিনি। বললেন, ‘‘একসঙ্গে আটটা ট্রাক যাচ্ছে। আমরা রাতের বেলায় জাতীয় সড়কের ধারে ট্রাক থামিয়েই বিশ্রাম নিই। একপাশে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করি।’’ এখানে এত বড় ধাবা আছে, পড়শির কাছে সে কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
পুরণজিৎ কুমারের পড়শিও পণ্যবাহী ট্রাকের চালক। তিনিই বাতলে দিয়েছিলেন, খাওয়ার সঙ্গে স্নান, বিশ্রামের সব সুবিধেই ধাবায় মিলবে। এত বড় জায়গা, দুটো পেল্লায় স্নানের চৌবাচ্চা, চল্লিশটা শৌচাগার! কংক্রিটে বাঁধানো বেদির এক পাশে রাখা আছে কম্বল। একটি কম্বল নিয়ে বেদিতে ঘুমোতে পারেন যে কেউ। তার জন্য আলাদা কোনও টাকা দিতে হয় না।
ধাবার উল্টো দিকে সার দিয়ে প্রায় দেড়শো দোকান। পান, সিগারেট, ঠান্ডা পানীয়ের সঙ্গে ব্যাগ, বাহারি জিনিসের দোকানও রয়েছে। ডুয়ার্স ঘুরতে আসা পর্যটকদেরও অনেকেই যাওয়ার ফাঁকে ঝাঝাঙ্গি ঘুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেই আসেন। পর্যটকদের জন্য মাটি, কাপড়ের নানা হাতের কাজ বিক্রির দোকানও গড়ে উঠেছে। দোকানগুলি অবশ্য ধাবা তৈরির অনেক পরে হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা হিরণ্ময় রায় বলেন, ‘‘ধাবা যখন থেকে জমজমাট হতে শুরু করে, তখন থেকেই একটার পর একটা দোকান হতে থাকে।’’
তবে ঝাঝাঙ্গি ব্যতিক্রম। এমন আক্ষরিক অর্থেই নির্মল ধাবার দেখা সচরাচর মেলে না। বরং উত্তরবঙ্গের বেশির ভাগ ধাবাতেই চলে গোপনে মদের কারবার। তাতে বিপদও ঘটে। বছর আটেক আগে বালুরঘাটের চকভৃগুর রেলস্টেশন পাড়ার একটি ধাবায় ভেজাল মদ খেয়ে এক মহিলা-সহ ৯ জনের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। কারও শাস্তি হয়নি। সেই মামলা আজও চলছে।
পরিস্থিতি অবশ্য কিছুটা পাল্টাচ্ছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অনেক ধাবার চেহারা বদলে গিয়েছে। পানশালার লাইসেন্সও মিলছে। আবগারি দফতরের একাধিক অফিসার জানিয়েছেন, ধাবায় যে মদ বিক্রি হয়, তা কারও অজানা নয়। সে জন্য ধাবাগুলির তরফে চাইলে ও প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করলে মদ বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়েছে। ইস্টার্ন হিমালয়ান ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের মত, পাহাড়ি রাস্তায় সেবক ও লাগোয়া এলাকা ও ডুয়ার্সের পথে যে সব ধাবা রয়েছে সেগুলির চেহারা ফেরাতে সরকারি স্তরেও চিন্তাভাবনা হোক। কারণ, ধাবার আধুনিকীকরণ হলে সেখানে আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা তো বটেই, পর্যটকদের আনাগোনাও বাড়বে। (শেষ)
(সহ প্রতিবেদন: অনির্বাণ রায়, দীপঙ্কর ঘটক, নারায়ণ দে, অনুপরতন মোহান্ত)