‘রক্ষাকবচে’ ফেরেনি আস্থা

চাষির ভরসা সেই ফড়েদের উপরেই

সাকুল্যে পেরোলো দু’বছর। আবার উল্টো স্রোত! সরকারি ‘রক্ষাকবচে’ আস্থা নেই। এ রাজ্যের বহু চাষি ধান বিক্রি করতে ফের ফড়েদেরই দ্বারস্থ হচ্ছেন। ফলে, ধানের বাজারে ফিরে এসেছে ফড়েদের রমরমা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:৫৩
Share:

সাকুল্যে পেরোলো দু’বছর। আবার উল্টো স্রোত! সরকারি ‘রক্ষাকবচে’ আস্থা নেই। এ রাজ্যের বহু চাষি ধান বিক্রি করতে ফের ফড়েদেরই দ্বারস্থ হচ্ছেন। ফলে, ধানের বাজারে ফিরে এসেছে ফড়েদের রমরমা।

Advertisement

অথচ, ফড়েদের হাতে প্রতারিত না হয়ে চাষিরা যাতে ন্যায্য দাম পান, সে জন্য রাজ্য সরকার সহায়ক-মূল্যে গত দু’টি মরসুমে চেকের মাধ্যমে ধান কেনে। সেই উদ্যোগে ভাল সাড়া মিললেও এ বার ভাটার টান। চাষিরা আর সরকারি শিবিরের দিকে সে ভাবে যাচ্ছেন না। ফড়েদের কাছে বা খোলা বাজারে দাম কম মিলছে। তবু অসহায় চাষি সেখানেই যাচ্ছেন।

কেন? চাষিরা তো বটেই, কৃষি দফতরের কর্তাদের একাংশ মানছেন, এ বার সহায়ক-মূল্যে ধান কেনা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়া এর অন্যতম কারণ। অন্যবার ধান কেনা শুরু হয়ে যায় ডিসেম্বরের গোড়াতেই। এ বার তা শুরু হয়েছে জানুয়ারিতে। তা ছাড়া, চেকের মাধ্যমে টাকা পেতে আগের দু’বার বহু চাষিকে ভুগতে হয়েছে। অনেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না। আবার দেরিতে অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়াও একটি কারণ। উঠেছিল চেক নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগও।

Advertisement

এ বার তাই কৃষি দফতর সিদ্ধান্ত নেয়, ৪৫ কুইন্টাল পর্যন্ত ধান কেনার টাকা সরাসরি চাষির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ফেলে দেওয়া হবে ৭২ ঘণ্টা পরেই। ৪৫ কুইন্টালের বেশি হলে টাকা দেওয়া হবে চেকের মাধ্যমে।

কিন্তু এ বারেও টাকা পেতে দেরি হচ্ছে বলে অভিযোগ। তা ছাড়া, সরকার যে ভাবে ধানে ‘বাটা’র (তুষ, নোংরা ইত্যাদির কারণে যে পরিমাণ ধান বাদ যায়) ব্যবস্থা রেখেছে তা না-পসন্দ অনেক চাষিরই। তাঁদের অভিযোগ, এক কুইন্টাল ধান বিক্রি করতে গেলে সরকারকে ৬ কেজি ‘বাটা’ দিতে হচ্ছে। কিন্তু খোলা বাজারে সে সব ঝামেলা নেই। তাই চাষিরা সরকারি সিদ্ধান্তে আস্থা রাখতে পারছেন না।

ফেব্রুয়ারি মাস শেষ। ১ মার্চ থেকে আলু রাখার জন্য খুলে যাচ্ছে রাজ্যের হিমঘর। চাষিরা আলু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার আগে তাই খোলা বাজারে তড়িঘড়ি ধান বিক্রি করে হাঁফ ছাড়তে চাইছেন। এ বার সরকার কুইন্টালপ্রতি ১৪৭০ টাকা ধানের দাম দিচ্ছে চাষিকে। ধান বহনের জন্য ভ্যান খরচ বাবদ বাড়তি দেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা। সেখানে খোলা বাজারে কুইন্টালপ্রতি ধান বিকোচ্ছে ১১৫০- ১১৬০ টাকায়। চাষিরা তাতেই খুশি। ফলে, পোয়া বারো ফড়েদের। তারা শুধু চাষিদের ধান কম দামেই কিনছে না, ঘুরপথে বেশি টাকায় সরকারকে বিক্রিও করছে বলে অভিযোগ। সরকারি কর্তাদের একাংশ মানছেনও, সরকারের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার পিছনে ছুটতে গিয়েই ফড়ে আর দালালদের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে।

রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ বর্ধমানের কালনা মহকুমার নিগুজি বাজারের ধান ব্যবসায়ী আলিম শেখ তো বলেই দিলেন, ‘‘গতবার আমি আড়াই হাজার বস্তা (৬০ কেজিতে এক বস্তা) ধান কিনেছিলাম। এ বার এখনও সাড়ে ৩ হাজার বস্তা ছাড়িয়ে গিয়েছে। চাষিরা হ্যাপা পোহাতে চাইছেন না বলেই আমাদের ধান বিক্রি করছেন।’’

মেদিনীপুর সদর ব্লকের এনায়েতপুরের ধান ব্যবসায়ী কানাইলাল গুছাইতও বলেন, ‘‘গত বছর ৪০০ কুইন্টাল ধান কিনেছিলাম। এ বছর এরই মধ্যে ৩০০ কুইন্টাল কেনা হয়ে গিয়েছে। চাষিরা ধান বিক্রি করতে এলে আমরা তো ফিরিয়ে দিতে পারি না।’’

চাষিদের গলায় অসহায়তার সুর। হুগলির তারকেশ্বরের রামনগর এলাকার চাষি সুব্রত ঘোষ বলেন, ‘‘চালকল-মালিকদের চাপে সরকার ‘বাটা’ তোলে না। তাই ইচ্ছে থাকলেও সরকারকে ধান বিক্রি করতে পারি না।’’ ওই এলাকারই আর এক চাষি গোবিন্দ ঘোষের কথায়, ‘‘বাইরে ধান বেচলে বাটা লাগছে না। উল্টে হাতে হাতে ধানের টাকা পাচ্ছি। সরকারি চেকের টাকা কবে নগদ হয়ে হাতে আসবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়?’’ মন্তেশ্বরের চাষি বুধ ঘোষ বলেন, ‘‘সহায়ক-মূল্যে ধান বিক্রি করার পরে যে চেক দেওয়া হয়, তা ভাঙাতে অনেক সময় লাগে। দরকারের সময় টাকাও মেলে না। এ বার ভেবেছিলাম কিছু ধান বিক্রি করব সহায়ক মূল্যে। তবে, ব্যাঙ্কে সরাসরি টাকা না ঢুকলে সবটাই ফড়েদের দেব।’’

এ বার সরকার ৫২ লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই লক্ষ্যমাত্রা কতটা পূরণ হবে, সে প্রশ্নও উঠছে। শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে এ বার সহায়ক-মূল্যে চার লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এখনও পর্যন্ত মাত্র ৬০ হাজার টন কেনা হয়েছে।

মেদিনীপুর সদর ব্লকের মণিদহ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান অঞ্জন বেরা মানছেন, “সহায়ক-মূল্যে ধান বিক্রি করতে এলাকার অনেক চাষিই উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। তাঁরা কোনও ঝুটঝামেলায় যেতে চাইছেন না। খোলাবাজারেই ধান বিক্রি করছেন।”

কী ভাবছে কৃষি দফতর? সরকারি শিবিরে ধান বিক্রি করতে চাষিদের যে উৎসাহ কমছে, তা মানতে রাজি নন কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। তাঁর দাবি, ‘‘চাষিদের উৎসাহ রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ঠিকই পূরণ হবে।’’ অবশ্য একই সঙ্গে তিনি মেনে নিয়েছেন, ‘‘ব্যাঙ্কের টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু কিছু সমস্যা হচ্ছে। ব্যাঙ্কার্স কমিটির সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। দ্রুত সমস্যার মীমাংসা হবে।’’

এখন দেখার চাষি আশ্বাসে ভরসা রেখে কতটা সরকারি শিবিরমুখী হন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন