ছিটমহলে চলছে জনগণনা। সোমবার হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।
ভারত-বাংলাদেশের যৌথ গণনাকারী দলের সদস্যরা পৌঁছতেই বেজে উঠল শাঁখ। উলুধ্বনি দিয়ে শুরু হল তাঁদের বরণ করে নেওয়ার তোড়জোড়। মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষেরাও এগিয়ে এলেন তাঁদের অ্যাপ্যায়নে। বাতাসা দিয়ে মিষ্টি মুখ করানো হল উপস্থিত সকলকে। তারপর একে একে প্রশাসনের তৈরি শিবিরে এসে নিজেদের নাম পরিচয় দিয়ে গণনা সমীক্ষায় নিজেদের নাম লিপিবদ্ধ করতে রীতি মতো লম্বা লাইনে দাঁড়ালেন বাসিন্দারা। কোচবিহার জেলা লাগোয়া বাংলাদেশি ছিটমহল শিবপ্রসাদমুস্তাফি এলাকায় এমন ছবিই দেখা গেল।
মধ্য মশালডাঙা, করলা, পোয়াতেরকুঠী, পশ্চিম মশালডাঙা সহ অন্য ছিটমহলগুলিতেও ছিল একই ছবি। উৎসাহী বাসিন্দারা শিবিরে সোমবার এসে ভিড় করেছেন দিনভর। সব মিলিয়ে রীতিমতো উৎসবের মেজাজে শুরু হল দুই দেশের যৌথ জনগণনা। পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ছিটমহল জনসমীক্ষা। কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন বলেন, “সমস্ত ছিটমহলেই গণনা কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা পৌঁছে গিয়েছে। নির্বিঘ্নে কাজ শুরু হয়েছে। ১৬ জুলাই পর্যন্ত ওই কাজ চলবে। এদিন মানুষের স্বতস্ফূর্ত সাড়া দেখা গিয়েছে।”
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ভারতের সীমানা ঘেরা বাংলাদেশের ৫১টি ও বাংলাদেশের সীমানা ঘেরা ভারতের ১১১টি ছিটমহল রয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের ৩৭টি ও ভারতের ৬৯টি ছিটমহলে জনবসতি রয়েছে। সম্প্রতি দুই দেশের সরকার ওই ছিটমহলগুলি দেশের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত করার ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করে। সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ৩১ জুলাই মধ্য রাত থেকে ছিটমহল বলে কিছু থাকছে না। ওই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নেই দুই দেশের আধিকারিক পর্যায়ের বৈঠকে যৌথ জনসমীক্ষার মাধ্যমে জনগণনার পাশাপাশি ছিটমহলের বাসিন্দাদের কে কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে চান, তা জানার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রশাসনের কর্তাদের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিরাও এদিন ওই কাজ দেখতে ছিটমহলে যান। মধ্য ও পশ্চিম মশালডাঙায় শিবিরে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন কোচবিহারের নাটাবাড়ির বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। দিনহাটার মহকুমা শাসক কৃষ্ণাভ ঘোষও এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখেন। সর্বত্র শিবিরে পুলিশের ছিল কড়া নজরদারি। রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিক উদ্যোগেই ছিটমহলগুলির ৫২ হাজারের বেশি বাসিন্দা নাগরিকত্বহীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। দেশের ভূখণ্ডে মিশে যাওয়া ছিটমহলের বাসিন্দারা সমস্ত পরিষেবা পাবেন। বাংলাদেশি ছিটমহলের যারা এদেশের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইবেন তাঁদেরও স্বাগত জানান হবে।”
প্রশাসনের কয়েকজন আধিকারিক জানান, ২০১১ সালে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলগুলিতে প্রথমবার জনগণনা করা হয়। সরকারিভাবে নাম দেওয়া হয় ‘হেড কাউন্ট’। ওই জনগণনার তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের ছিটমহলে ১৪ হাজারের কিছু বাসিন্দা রয়েছেন। ভারতীয় ছিটমহলের জনসংখ্যা ৩৭ হাজারের কিছু বেশি। এ বার ওই তালিকার নাম পদবি ঠিকানা মিলিয়ে দেখবেন যৌথ গণনাকারীরা। ভারতীয় ছিটমহলগুলিতে ৫০টি ও বাংলাদেশের ছিটমহলগুলিতে ২৫টি গণনাকারী দল কাজে নেমেছেন। দুই দেশের বাসিন্দা শতাধিক কর্মী ওই কাজ করছেন। পুরানো তালিকাভুক্তদের পরিবারের কারও মৃত্যু, জন্ম কিংবা বিয়ে হলে সে সব তথ্য সংগ্রহ করে ওই তালিকায় প্রয়োজন অনুযায়ী সংযোজন ও বিয়োজন করা হবে। সেই সঙ্গে দুই দেশের ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে কারা ঠিকানা বদলে অন্য দেশের নাগরিকত্ব পেতে চান তাঁদের তালিকা তৈরি করা হবে। গণনাদলের সদস্যরা ওই বাসিন্দাদের ছবিও তুলবেন।
এদিন বাংলাদেশি ছিটমহল শিবপ্রসাদমুস্তাফির জনসমীক্ষা শিবিরের সামনে দাঁড়িয়ে বাসিন্দারা প্রায় সকলেই জানিয়ে দেন, তাঁরা ভারতীয় নাগরিকত্ব চান। সেখানকার বাসিন্দা ঈশ্বর দেবনাথ, সুভদ্রা দেবনাথরা বলেন, “ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছি। দীর্ঘ দিন ধরে ওই স্বপ্নই তো দেখছিলাম। এত দিনে তা পূরণ হচ্ছে। তাই গণকাকারীরা শেষের দিকে বাড়ি বাড়ি যাবেন জেনেও শিবিরে চলে এসেছি।” পোয়াতেরকুঠির প্রবীণ বাসিন্দা মনসুর আলি মিঁয়া বলেন, “আমারও এক ইচ্ছে।” যা দেখে আপ্লুত বাংলাদেশের পাটগ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক মহাবুবুর রহমান, দিনহাটার বাসিন্দা মহকুমা শাসক দফতরের কর্মী সজল সরকারের মতো যৌথ গণনাকারীদলের সদস্যরা। তাঁদের কথায়, এমন ইতিহাসের সাক্ষী থাকাটাই আনন্দের। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহকারী সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “বালাপুখুরি, ফলনাপুর, মৃগীপুরের মতো কয়েকটি ছিটমহলে গণনাকারীরা খানিকটা দেরিতে পৌঁচ্ছন। তবে সর্বত্র ব্যাপক সাড়া ছিল। ২০১১ সালে জনগণনার সময় বাড়ি বাড়ি গিয়েও কর্মীরা এমন উৎসাহ দেখেননি।”