maoist attack

জঙ্গলমহলের গ্রামে গুলি, বাঁচতে ঝাঁপ ব্যবসায়ীর স্ত্রীর, সন্দেহ মাওবাদীদের দিকে

ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশ মুখ খুলতে না চাইলেও এলাকার বাসিন্দা থেকে আহত বিদ্যুৎ সকলেরই দাবি, মাওবাদীরাই গুলি চালিয়ে শাসিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২০ ১০:৩৯
Share:

ঘটনাস্থলে সিআরপিএফ জওয়ানরা। ইনসেটে মাওবাদী নেতা মদন মাহাতো। নিজস্ব চিত্র।

লেভি বাবদ মোটা টাকা দাবি করেছিল মাওবাদীরা। গোটা ঘটনা পুলিশকে জানিয়েছিলেন বেলপাহাড়ির পচাপানি গ্রামের বাসিন্দা বিদ্যুৎ দাস। তার ঠিক এক মাস বাদেই অজ্ঞাতপরিচয় কিছু ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে এসে বাড়িতেই বিদ্যুৎ এবং তাঁর স্ত্রীকে লক্ষ্য করে গুলি চালালো। গুলি থেকে বাঁচতে ছাদ থেকে ঝাঁপ মারেন বিদ্যুতের স্ত্রী। মাটিতে পড়ে পা ভেঙেছেন তিনি। গোটা ঘটনা নিয়ে ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশ মুখ খুলতে না চাইলেও এলাকার বাসিন্দা থেকে আহত বিদ্যুৎ সকলেরই দাবি, টাকা না দেওয়ায় মাওবাদীরাই গুলি চালিয়ে শাসিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের পলিটব্যুরো সদস্য এবং শীর্ষ নেতা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষানজির মৃত্যুর পর দীর্ঘ ন’বছর মাওবাদীদের কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বাংলার মাটিতে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দারা খবর পেয়েছেন, ফের এ রাজ্যে সংগঠন তৈরির চেষ্টা করছে লাল গেরিলারা। তার কিছু নমুনাও পাওয়া গিয়েছে গত কয়েক মাসে। মাওবাদী নেতাদের আনাগোনা, গ্রামে বৈঠকের খবর পাচ্ছিলেন গোয়েন্দারা। এ বছর স্বাধীনতা দিবসের আগে গ্রামে গ্রামে কালো পতাকা তোলার ফতোয়াও দেয় মাওবাদীরা। গত ১৫ অগস্ট সকালে বেলপাহাড়ির বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতা দিবসকে ‘কালা দিবস’ পালন করার ডাক দিয়ে মাওবাদী পোস্টারও পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামে ঢুকে গুলি চালানোর মতো বেপরোয়া হয়ে উঠবে মাওবাদী স্কোয়াড, এমনটা ভাবতে পারেননি এলাকার বাসিন্দা থেকে শুরু করে জেলা পুলিশের কর্তারাও। বৃহস্পতিবার রাতে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া পচাপানি গ্রামে বিদ্যুৎ দাসের ঘটনা ফের উস্কে দিয়েছে আতঙ্ক।

পচাপানি গ্রামটি বেলপাহাড়ি থানা এলাকায় শিমূলপাল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে পড়শি রাজ্যের সীমানা ঘেঁষা এই গ্রাম শক্ত ঘাঁটি ছিল লাল গেরিলাদের। কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ (সিআরপিএফ)-এর ১৬৯ ব্যাটালিয়নের সদর দফতর নেগুরিয়া ক্যাম্প থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পচাপানি কয়েক বছর আগেও প্রত্যন্ত ছিল। সম্প্রতি সড়ক যোগাযোগ অনেকটাই ভাল হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: সেপ্টেম্বরে পরীক্ষা হবে না রাজ্যে ।। পরীক্ষা না নিয়ে পাশ নয়: কোর্ট​

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ কয়েক জন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি বিদ্যুৎ দাসের বাড়ির সামনে এসে তাঁর নাম ধরে ডাকাডাকি করে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাসের এজেন্সি আছে বিদ্যুতের। এলাকার সম্পন্ন ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত তিনি। ডাক শুনে বিদ্যুতের সন্দেহ হয়। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মীরা ছাদে উঠে দেখার চেষ্টা করেন কারা ডাকাডাকি করছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, বিদ্যুৎ প্রথমে সাড়া না দেওয়ায় এবং তার পরে তাঁকে ছাদে দেখে ওই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের ধারণা হয় বিদ্যুৎ পালানোর চেষ্টা করছেন। তখন তারা ছাদ লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। ভয়ে ছাদ থেকে ঝাঁপ মারেন বিদ্যুতের স্ত্রী মীরা। মাটিতে পড়ে পা ভাঙে তাঁর। গুলির শব্দ শুনতে পান এলাকার মানুষও। তবে তাঁদের অধিকাংশই আতঙ্কে বাইরে বেরোননি। বিদ্যুৎকে শাসিয়ে চলে যায় ওই বন্দুকবাজরা। এর আগে জুলাই মাসের ২৭ তারিখ বিদ্যুতের বাড়িতে মাওবাদী নেতা মদন মাহাতোর সই করা একটা চিঠি আসে। সেই চিঠিতে মাওবাদী সংগঠনের লেভি (চাঁদা) বাবদ দু’লাখ টাকা দাবি করা হয়। ২৯ জুলাই পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল টাকা দেওয়ার জন্য। টাকা না দিলে ‘চরম শাস্তি’ দেওয়া হবে বলেও শাসানো হয়েছিল। এলাকার বাসিন্দাদের অনুমান সেই টাকা না দেওয়ার জন্যই ঠিক এক মাসের মাথায় ফের হাজির হয়েছিল মাওবাদী গেরিলারা।

আরও পড়ুন: নিট-মামলা ৬ রাজ্যের, বার্তা সনিয়ার

গোটা ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি জেলা পুলিশের কর্তারা। তবে বেলপাহাড়ি থানা এবং বাঁশপাহাড়ি পুলিশ চৌকির যে আধিকারিকরা গোটা ঘটনার তদন্ত করছেন, তাঁদের একজন বলেন,‘‘ এটাও দেখা দরকার মাওবাদীদের নাম করে কেউ এই ঘটনা ঘটালো কি না? কারণ ওই এলাকায় লালগড় আন্দোলনের সময়ে অনেকের হাতেই অস্ত্র এসেছে। এবং তা এখনও রয়ে গিয়েছে।” তাঁর ব্যাখ্যা, মাওবাদীরা চিঠি দিয়ে ২ লাখ টাকা চেয়েছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনও স্থানীয় দুষ্কৃতী দলও এই কাজ করে থাকতে পারে। সেই দিকটাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

তবে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, এটা খুব প্রত্যাশিত ঘটনা। তবে এত তাড়াতাড়ি হবে তা তাঁরাও আশা করেননি। এক গোয়েন্দা কর্তা ব্যাখ্যা করে বলেন, “বেশ কিছু বছর নিষ্ক্রিয় থাকার পর নিজেদের সংগঠন পুনর্গঠন করেছে মাওবাদীরা। আগের থেকে তারা এখন ওই এলাকায় অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চাইছে। কোনও একটা ঘটনা ঘটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জঙ্গলমহলে রয়েছে তা প্রমাণ করতে মরিয়া মাওবাদীরা।”

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তা বলেন, “সংগঠনের দু’জন প্রবীণ পলিটব্যুরো সদস্যের তদারকিতে সংগঠনের পুনর্গঠনের কাজ করছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য অসীম মণ্ডল ওরফে আকাশ এবং পতিরাম মাঝি ওরফে তুফান বা অনলদা।”

মাওবাদী দমনে নিযুক্ত সিআরপিএফের কর্তারাও স্বীকার করেন বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানায় আগের থেকে শক্তিশালী হয়েছে মাওবাদী সংগঠন। এক কর্তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, “কয়েক মাস আগে পর্যন্তও দূর পাল্লার পেট্রোল বা টহলদারিতে সিংভূমের পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত এলাকায় মাঝে মাঝে সিআরপিএফের মুখোমুখি হয়ে যেত মাওবাদী স্কোয়াড। কিন্তু তারা তখন পালাতে ব্যস্ত থাকত। পাল্টা হামলা করার চেষ্টা করত না।” ওই সিআরপিএফ কর্তার অভিজ্ঞতায় গত ছ’মাসে অন্যরকম ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, “সম্প্রতি বেশ কয়েক বার মাওবাদী স্কোয়াড আমাদের বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করছে। এর থেকেই স্পষ্ট যে ওরা শক্তিবৃদ্ধি করেছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন