গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন কিছু ‘কুচক্রী’। সেখানে গিয়ে তাঁদের নাম, ফোন নম্বর-সহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছেন তাঁরা। বিনিময়ে ভোটারদের হাতে ধরাচ্ছেন হলুদগুঁড়ো, লঙ্কাগুঁড়োর মতো মশলাপাতি এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী! এর নেপথ্যে বড় ষড়যন্ত্র রয়েছে, এই মর্মে রবিবার সার্কুলার জারি করে দলীয় নেতাদের সতর্ক করেছিল শাসকদল তৃণমূল। ঠিক তার পরেই বাঁকুড়ায় গ্রেফতার দুই মহিলা-সহ মোট পাঁচ জন। ধৃতদের দাবি, তাঁরা জনমত সমীক্ষা করতে গিয়েছিলেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, বাঁকুড়ার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতেরা রবিবার হরিয়ানার একটি সংস্থার কর্মী বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছিলেন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার নাম করে তাঁরা স্থানীয়দের আধার এবং ভোটার কার্ডের প্রতিলিপি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। এতেই সন্দেহ হয় ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সম্পাদক টুটুন দাসের। এর পরেই তিনি বিষয়টি বাঁকুড়া সদর থানায় জানান। তড়িঘড়ি পুলিশ এলাকায় গিয়ে ওই ৫ জনকে আটক করে। পরে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।
টুটুন বলেন, ‘‘পাঁচ জন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোটার ও আধার কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করছিল। সন্দেহ হওয়ায় আমরা থানায় লিখিত অভিযোগ করে তদন্তের দাবি জানাই।’’ পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের নাম আরতি মোদক, শিখা মাজি, প্রবীর ঘোষ, হারাধন লোহার এবং সুদীপ মণ্ডল। সুদীপের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের বড়শুল এলাকায়। প্রবীর এবং হারাধনের বাড়ি বাঁকুড়ার সোনামুখী থানার ভগবানপুর গ্রামে। ধৃত দুই মহিলার বাড়ি বাঁকুড়া শহরের বিবেকানন্দপল্লি এলাকায়।
সুদীপ বলেন, ‘‘আমরা একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী হিসাবে জনমত সমীক্ষা করতে বাঁকুড়ায় এসেছিলাম। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কাছে সমীক্ষার অনুমতি চাইতে গেলে পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করে। পুলিশ কেন আমাদের গ্রেফতার করেছে, তা আমরা জানি না।’’
ধৃতদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সুরক্ষা সংহিতার ১৮০ নম্বর ধারা এবং ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৩২৯(৪), ৩১৯(২), ৩১৮(৪), ৩৫১(২), ৩(৫), ৬১(২) ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। ধৃতদের সোমবার বাঁকুড়া জেলা আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। বিচারক ধৃতদের ২ দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার বৈভব তেওয়ারি বলেন, ‘‘ধৃতেরা নিজেদের সমীক্ষক বলে দাবি করে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছিলেন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার নাম করে ওই এলাকার মানুষদের কাছ থেকে আধার কার্ড ও ভোটার কার্ডের প্রতিলিপি ও তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। অভিযোগ পেয়ে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে । ধৃতদের কাছ থেকে বেশ কিছু আধার কার্ড ও ভোটার কার্ডের প্রতিলিপি উদ্ধার করা হয়েছে। ধৃতেরা যে সংস্থার নাম করে এই কাজ করছিলেন, সেই সংস্থার এখনও কোনও হদিস মেলেনি। আমরা ধৃতদের হেফাজতে নিয়ে আরও বিশদ তথ্য জানার চেষ্টা করছি।’’
এর নেপথ্যে বিজেপির হাত রয়েছে বলেই মনে করছে তৃণমূল। যুব তৃণমূলের বাঁকুড়া সাংগঠনিক জেলার সভাপতি রাজীব দে বলেন, ‘‘বিজেপির জনপ্রতিনিধিদের মানুষ কোনও দিন পাশে পাননি। তাই তাঁরা এখন মানুষের কাছে যেতে পারছেন না। এই ধরনের বিভিন্ন এজেন্সিকে দিয়ে মানুষের কাছে পাঠাচ্ছে বিজেপি। আমরা সতর্ক। এই ধরনের চক্রান্ত আমরা রুখবই।’’ পাল্টা বিজেপির বাঁকুড়া সাংগঠনিক জেলার সভাপতি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলের অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, ‘‘বিজেপি কোনও সমীক্ষক দল পাঠায়নি। এই বাংলার মানুষের হাতে কোনও কাজ নেই। ভিন্রাজ্যের সংস্থার হয়ে অনেকে এই ধরনের কাজ করছেন। তৃণমূল এ ভাবে তাঁদেরও ভাতে মারার ব্যবস্থা করছে।’’
প্রসঙ্গত, রবিবার তৃণমূলে জারি হওয়া সার্কুলারে লেখা হয়েছে, ‘‘এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নামে কিছু কুচক্রী ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোথাও মশলা, আবার কোথাও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ করে পরিবর্তে তাঁদের নাম, ফোন নম্বর ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করছেন।’’ দলীয় নেতাদের উদ্দেশে বার্তা, ‘‘অবিলম্বে আপনার / আপনাদের অঞ্চলে লক্ষ্য রাখুন এবং সর্ব স্তরের বুথকর্মীদের নিয়ে মিটিং করে সকলকে সচেতন ও সতর্ক করুন।’’ ‘কুচক্রী’রা দলের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপেও ঢুকে পড়ছেন বলে জানিয়ে দলীয় নেতাদের সতর্ক করা হয়েছে। সার্কুলারে লেখা হয়েছে, ‘‘এদের উদ্দেশ্য আমাদের সমস্ত অভ্যন্তরীণ খবরাখবর নেওয়া। তাই আপনি খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এফআইআর করুন এবং আমাদের জানান।’’
শাসকদল সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধু ভোটারদের বাড়িই নয়, তৃণমূলের বুথ এবং অঞ্চলের নেতাদের কাছেও যাচ্ছেন অনেকে। তাঁরা বুথ বা অঞ্চলের নেতাদের বলছেন যে, তাঁদের শীর্ষ নেতৃত্ব পাঠিয়েছেন। এ সব বলেই তাঁদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন তাঁরা। সম্প্রতি জঙ্গলমহলের বিনপুরে এ রকমই একটি ঘটনা ঘটে। এর পরেই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। আলোচনাও হয় দলের অন্দরে। তার পরেই সার্কুলার জারি করেন তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার। ঘটনাচক্রে, তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাঁকুড়ায় পাঁচ জন গ্রেফতার।