নির্বিচার নির্মাণে সঙ্কটে জঙ্গল, প্রাণীরাও

বদলে যাচ্ছে জয়ন্তীর চেহারা। নদী-পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা ভুটান সীমান্তের মনোরম এলাকায় এখন দিন-রাত যেন হট্টগোলের শেষ নেই। কাকভোরেই হুসহাস করে সাফারিতে ব্যস্ত সারি সারি গাড়ি।

Advertisement

নারায়ণ দে

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:৪৪
Share:

পরিবেশের তোয়াক্কা না করে জয়ন্তী নদীর খাত থেকে অবাধেই চলে পাথর তোলা। ছবি: নারায়ণ দে।

বদলে যাচ্ছে জয়ন্তীর চেহারা।

Advertisement

নদী-পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা ভুটান সীমান্তের মনোরম এলাকায় এখন দিন-রাত যেন হট্টগোলের শেষ নেই। কাকভোরেই হুসহাস করে সাফারিতে ব্যস্ত সারি সারি গাড়ি। পুরনো সব গাড়ির কোনটির আওয়াজ এতটাই বিকট যে চমকে উঠতে হয়। নির্জন বনাঞ্চলে হর্ন বাজানো নিষেধ। তবুও হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা চলে বলে অভিযোগ।

পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেসরকারি ‘লজ’-এর সংখ্যাও। যে জয়ন্তীতে ১০ বছর আগে একটিও বেসরকারি হোটেল ছিল না, সেখানে এখন ইতিউতি লজ গড়ে উঠছে। জয়ন্তী, রাজাভাত খাওয়ার পানিঝোরা বস্তিতে গজিয়ে গঠছে একের পর এক হোটেল। অভিযোগ, এতেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে পরিবেশের ভারসাম্য। তাই জঙ্গলে যানবাহনের আনাগোনা বেড়েছে। সামগ্রিক ভাবে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে। যে অভিযোগ শুনেছেন রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মনও। তিনি উদ্বিগ্ন। তাঁর কথায়, ‘‘এমন হওয়া ঠিক নয়। জঙ্গল লাগোয়া বনবস্তি গুলোতে কোনও নির্মাণের অনুমতি বন দফতর দেয় না। খোঁজ নিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে।’’

Advertisement

জয়ন্তীর ভারসাম্যের হাল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমীক্ষা করছে আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাব। কী ভাবে কোর এরিয়ায় বেসরকারি লজ গড়ে উঠছে, জঙ্গলে শয়ে-শয়ে গাড়ি ঢুকছে সে সব তথ্য নেচার ক্লাবের হাতে রয়েছে। সংস্থার কর্ণধার অমল দত্ত বলেন, ‘‘বিভিন্ন এলাকায় সমীক্ষা করেছি। তার রিপোর্ট গ্রিন ট্রাইবুনালে দেওয়া হয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প ও জলদাপাড়া এলাকায় গজিয়ে উঠছে লজ। দূষিত হচ্ছে বিভিন্ন নদী। জঙ্গলের ওই সব অঞ্চলগুলিতে লোকজনের যাতায়াত বাড়ছে। এতে প্রভাবিত হচ্ছে বন্য জীবন।”

তবে আলিপুরদুয়ারের কংগ্রেস বিধায়ক তথা রাজ্য ওয়াইল্ড লাইফ বোর্ডের সদস্য দেবপ্রসাদ রায় কিন্তু ভিন্ন মতের অনুসারী। তাঁর মতে, কোথাও হোম স্টে হলে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কিছু নেই। তিনি জানান, অধিকাংশ একতলা টিনের ছাদ দিয়ে তৈরি হচ্ছে। কিছু দোতলা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘হোম স্টে হলে এলাকার অর্থনীতির ভিত শক্ত হবে।’’ তবে কংক্রিটের ঘরদোর তৈরির তিনি বিরোধী বলে জানিয়েছেন।

কিন্তু, পরিবেশপ্রেমীরা সকলেই জয়ন্তীর নির্জনতা নষ্ট করার বিপক্ষে। বিস্তীর্ণ এলাকার জঙ্গলে দিনভর কেন শয়ে-শয়ে গাড়ি দাপিয়ে বেড়াবে সেই প্রশ্নেই সরব তাঁরা। কোচবিহার, শিলিগুড়ি, বালুরঘাটের পরিবেশপ্রেমীরাও নানা সময়ে জয়ন্তী, বক্সায় গিয়ে সমীক্ষা করেছেন। তাতে দেখা গিয়েছে, বন্যপ্রাণীরা আগে নদীর যে সব এলাকায় যাতায়াত করত, সেখানে ইদানীং আসে না। আরও ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। সন্ধ্যার পরে বাইসনের পাল দেখাতে বেশ কিছু গাড়ি এতটাই গভীরে ঢুকে পড়ে যে তাতে বুনো জন্তুদের পিছু হটতে হচ্ছে বলে দাবি করেছেন পরিবেশপ্রেমীরা।

শুধু তাই নয়, ক্রমশ যে বক্সায় জঙ্গলের আয়তন কমছে তা নিয়েও উদ্বেগে রয়েছেন এলাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের অনেকেই। আলিপুরদুয়ারের প্রবীণ আইনজীবী জহর মজুমদার জানান, ৬০ দশকে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলের যা পরিধি ছিল তার অর্ধেক রয়েছে বর্তমানে। তাঁর মতে, ‘‘যেভাবে জয়ন্তী-সহ বিভিন্ন বনবস্তিতে নিয়মের তোয়াক্কা না করে মাথা তুলছে বিভিন্ন নির্মাণ তাতে পরিবেশের পক্ষে ভাল লক্ষণ নয়। একেই প্রায় হাতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে রেলে কাটা পড়ে। তার উপর এই ভাবে জঙ্গলের উপর চাপ বাড়তে থাকলেও পরিবেশ ও বন্যপ্রাণের উপর তার প্রভাব পড়বে।’’ আলিপুরদুয়ারে পরিবেশপ্রেমীদের তরফে অভিযোগ করা হয়েছে, একশ্রেণির পর্যটক জঙ্গল লাগোয়া লজগুলিতে থেকে ‘ক্যাম্প ফায়ার’-এর নামে রাতে জঙ্গলে ঢুকে হট্টগোল বাঁধাচ্ছেন। যত্রতত্র মদের বোতল ফেলছেন। প্লাস্টিক, বোতল-সহ বিভিন্ন আবর্জনা জয়ন্তী ও বালা নদীতে ফেলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। বিষয় গুলির উপর আরও নজরদারি দরকার। জঙ্গলে নির্মানের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা দরকার প্রশাসনের।

আলিপুরদুয়ারের কংগ্রেসের জেলা সভাপতি বিশ্বরঞ্জন সরকার জানিয়েছেন, অতীতে জয়রাম রমেশ কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রী থাকার সময়ে বক্সার সামগ্রিক উন্নয়নের ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ করেছিলেন। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘এখন কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও তরফেই বক্সা, জয়ন্তীর সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য সুষ্ঠু পদক্ষেপ করা হচ্ছে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন