রাজ্যপাল: কেশরীনাথ ত্রিপাঠী
তিনি রাজ্যপাল। তিনি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। এবং সেই পদাধিকারবলেই তিনি রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল-আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠী তা হলে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় নিজেকে কার্যত নখদন্তহীন বাঘ বলেই মনে করছেন কেন? সোমবার নিজেকে নখদন্তহীন বাঘের তকমা দেওয়ার সময়েই উপাচার্য নিয়োগে তাঁর ভূমিকার কথা তুলেছিলেন ত্রিপাঠী। ক্ষোভের সঙ্গেই আচার্য জানান, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তিনি উপাচার্য বাছাইয়ের সার্চ কমিটিতে এক জন সদস্য নিয়োগ করতে পারেন মাত্র। তার বেশি কিছু নয়!
উপাচার্য নিয়োগে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে ত্রিপাঠীর বক্তব্য ভুল নয় বলেই মনে করছে শিক্ষা শিবির। তাদের মতে, আশির দশকের অনন্তপ্রসাদ শর্মা থেকে এখনকার ত্রিপাঠী পর্যন্ত বিশেষত শিক্ষা নিয়ে আচার্য-রাজ্যপালদের ক্ষোভের দীর্ঘ পরম্পরা চলছে বাংলায়।
বাম জমানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট বা কোর্ট আচার্যের কাছে উপাচার্য-পদে তিনটি নাম প্রস্তাব করত। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পরপর কিছু বদল আনে। ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন আইনে প্রথম পরিবর্তন এনে রাজ্য বলেছিল, সার্চ কমিটি উপাচার্য-পদে তিনটি নাম সুপারিশ করবে। তাঁদের মধ্যে এক জনকে বেছে নেবেন আচার্য। সার্চ কমিটিতে আচার্যের প্রতিনিধি ছাড়াও থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট বা সেনেটের প্রতিনিধিরা।
তৃণমূল আমলের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সময়ে সার্চ কমিটিতে ইউজিসি-র সদস্যের জায়গায় আসেন রাজ্যের প্রতিনিধি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরে ঠিক হয়, সার্চ কমিটিতে রাজ্যপাল তাঁর মনোনীত সদস্যের নাম বাছবেন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে। ২০১৭-য়
উচ্চশিক্ষা আইন সংশোধন করে বলা হয়, উপাচার্য মনোনয়নে রাজ্যের সঙ্গে রাজ্যপালকে আলোচনা করতে হবে।
শিক্ষাজগতের পর্যবেক্ষণ, উচ্চশিক্ষায় এই ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন ত্রিপাঠী। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্সির সমাবর্তনে প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী বলেছিলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বা সরকারি হস্তক্ষেপ উচিত নয়।
শিক্ষা শিবির জানাচ্ছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ১৯৮৩ সালে উপাচার্য বাছতে তিনটি নাম পাঠায় রাজ্যপাল অনন্তপ্রসাদ শর্মার কাছে। প্রথম নামটি ছিল সন্তোষ ভট্টাচার্যের। পরের দু’জন হলেন রমেন পোদ্দার ও দেবকুমার বসু। রাজ্যপাল বেছে নেন সন্তোষবাবুকেই। এই নিয়ে তাঁর সঙ্গে বাম সরকারের সংঘাত চূড়ান্তে পৌঁছয়। বামফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কেরা রাজ্যপালের সব অনুষ্ঠান বয়কট করবে। দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর কাছে এই বিষয়ে অনুযোগ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়েও শর্মার সঙ্গে বাম সরকারের সংঘাত বেধেছিল। শর্মা যাননি যাদবপুরের সমাবর্তনেও।
শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায় জানান, উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যপালের ভূমিকা কতটা সক্রিয় হবে, রাজ্যের আইনে সেই বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। ‘‘তাই রাজ্যপাল যথাযথ পদক্ষেপ করতে পারেন না। কখনও কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেলেন। বাম আমলে শর্মা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বর্তমান রাজ্যপালও করছেন,’’ মঙ্গলবার বলেন অমলবাবু। আর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘সরকারই এখন উপাচার্য নিয়োগের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে!’’
শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবুর দাবি, তাঁরা আইনের বাইরে কিছু করছেন না। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যপাল তো স্পিকার ছিলেন। উনি সবই জানেন। উনি ওঁর অনুভবের কথা বলেছেন। রাজ্যপাল তো নির্বাচিত ব্যক্তি নন। রাষ্ট্রপতির মনোনীত। আমার দায়িত্ব বিধানসভায় পাশ করা আইন বলবৎ করা।’’